কয়েকজন বোধহীন বুদ্ধিমান রাজনৈতিক নেতাদের অবিমৃষ্যতার কারণে ১৯৪৭ সালে ভারত ভেঙ্গে পাকিস্তান হলো। দেশ ভাগ হবার আগ-পর যেসব হিন্দু ব্যক্তিবর্গ পাকিস্তান অংশে ছিলেন তাদের বড় একটা অংশ সহায় সম্পত্তি ফেলে পশ্চিম বাংলায় চলে গেলেন। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের মতো কিছু ব্যক্তি পূর্বপুরুষের ভুমি আঁকড়ে ধরে মাতৃভূমির মানুষদের সাথে নিয়ে বাঁচতে চাইলেন। আবার অন্যদিকে যোগেন মণ্ডলের মতো নেতারা উচ্চবর্ণের হিন্দুর থেকে মুসলিমরা শ্রেয় এই মূঢ় তত্ত্বে বিশ্বাস করে জিন্নাহ’র সাথে গাট বাঁধলেন। আদতে ভারতবর্ষের হিন্দুরা কখনো একতাবদ্ধ ছিলো না- যার কারণে ইরান, তুরান, মোগল, মঙ্গোল, সাত সাগরের পার থেকে বিভিন্ন হানাদাররা এসেছে আর এদেশ শাসন করেছে। ইংরেজরা যখন এদেশ ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে তখনো সনাতনীদের কোনো একক দল গড়ে ওঠেনি, নিজেদের মধ্যে কোনো ঐক্য নেই। সেসময় মুসলিমরা মোটা দাগে সবাই মুসলিমলীগের সাথে থাকলেও হিন্দুদের তেমন কোনো গ্রহনযোগ্য দল ছিলো না। হিন্দুদের কেও বাম, কেও কংগ্রেস ইত্যাদি রাজনৈতিক দলে বিভক্ত ছিলো।
১১ আগষ্ট ১৯৪৭ তারিখে পাকিস্তান এসেম্বলিতে জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া প্রথম ভাষণে জিন্নাহ বললেন, “Now I think we should keep that in front of us as our ideal and you will find that in course of time Hindus would cease to be Hindus and Muslims would cease to be Muslims, not in the religious sense, because that is the personal faith of each individual, but in the political sense as citizens of the State.” অর্থাৎ ‘আপনি যে কোনও ধর্ম বা বর্ণ বা গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন, কিন্তু দেশের প্রশাসন এবং কর্মপদ্ধতির সঙ্গে এর কোনও যোগসূত্র নেই। আমরা এই মৌলিক নীতিটি দিয়ে শুরু করছি যে আমরা সবাই রাষ্ট্রের নাগরিক যাঁদের সমানাধিকার সুরক্ষিত।’
কিন্তু বাস্তবতা ছিলো ভিন্নঃ
বঙ্গবন্ধু তাঁর আত্মজীবনীতে লিখছেনঃ
‘পূর্ব বাংলার সম্পদ কেড়ে নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানকে কত তাড়াতাড়ি গড়া যায় একদল পশ্চিমা নেতা ও বড় বড় সরকারি কর্মচারীরা গোপনে সে কাজ করে চলেছিল। ...শ্রমিক কৃষক মেহনতি মানুষ যে আশা নিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলন, যে পাকিস্তান আন্দোলনে শরিক হয়ে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে তাদের অর্থনৈতিক মুক্তির দিকে কোনো নজর দেওয়াই তারা দরকার মনে করল না।’ (আত্মজীবনী, পৃ ২৪০-২৪১)
অনেক রক্ত ঝরে ১৯৪৭ সালে যখন বেনিয়া ইংরেজদের বিদায় করা হলো, তখন আসলে আমরা যেটা পেলাম সেটা ছিল সোনার পাথরবাটি। পরিণাম দুরদর্শী নেতারা আগেই অনুমান করেছিলেন। গরম তেল থেকে উত্তপ্ত আগুনে ঝাঁপ দেবার অভিজ্ঞতা পেতে আমাদের বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি। পাকিস্তান ১৯৪৭ সালে রাজনৈতিক স্বাধীনতা পেলেও এর উভয় অংশের গণমানুষের স্বাধীনতা অধরা থেকে অধরাতর থেকে গেছে। বছরের পর বছর চলে গেছে কিন্তু একটা সংবিধান তৈরি করতে পারেনি। বাংলার মানুষেরা আরো অবহেলিত হতে থাকল। আর পাকিস্থানের হিন্দুদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠলো।
ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ১৯৪৮ সালের ২৫ আগস্ট পাকিস্তান গণপরিষদে অধিবেশনের সকল কার্যবিবরণী ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলাতেও অন্তর্ভুক্ত রাখার দাবি উত্থাপন করেন। গণপরিষদে তাঁর দেয়া যুক্তি খন্ডানোর কেও ছিলো না। কিন্তু যুক্তিকে কবরে পাঠিয়ে যে দেশের জন্ম সেখানে যুক্তির কথা কে শুনবে?
জিন্নাহ তথা পাকিস্থানবাদীরা বাংলা ভাষাকে বাঙ্গালিদের ভাষা নয়, বরং হিন্দুদের ভাষা রূপে আখ্যায়িত করার চেষ্টা করে এবং উর্দূকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করে। বাঙ্গালি সংস্কৃতি এবং হিন্দু সংস্কৃতি পাকিস্থানের কাছে ছিলো এক ও অভিন্ন সত্ত্বা। এবং এই তথ্যটি ঐতিহাসিকভাবে মোটাদাগে সত্য। সনাতন ধর্ম, ধর্ম হিসাবে যতখানি শক্তিশালী, তার থেকে হাজারগুণ শক্তিশালী এর সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ঠ্য। সেই বৈশিষ্ঠ্যগুলোই ছিলো পাকিস্থানের ভয়। হাজার বছর ধরে সনাতনী তথা ভারতবর্ষের শক্তিশালী যে সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য রয়েছে তাঁকে পাশ কাটিয়ে পাকিস্থানে এক কিংভুতকিমাকার ইসলামী সংস্কৃতি তৈরির চেষ্টা করা হয়।
জাতি বৈশিষ্ট্যের কারণে হিন্দুদের উপর প্রথম রাষ্ট্রীয়ভাবে আঘাত আসে “শত্রু সম্পত্তি আইন” এর মাধ্যমে। এই আইনের দ্বারা ভুমিপুত্র হিন্দুদের জমি সরকারিভাবে গ্রাস করা হয়।
এই ফাঁকে কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের পরিণতির কথা বলে যাই। পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর ১৯৬০ সালে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের উপর ‘এবডো’ (Elective Bodies Disqualification Order) প্রয়োগ করা হয়। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তাঁকে গৃহবন্দি করা হয়। ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ রাতে পুত্র দিলীপকুমার দত্তসহ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে গ্রেফতার করা হয় এবং তাঁদেরকে ময়নামতী সেনানিবাসে নিয়ে অত্যন্ত ঘৃণ্য উপায়ে হত্যা করা হয়।
পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই জিন্না উর্দু ভাষা ভিত্তিক একটি জাতীয়তাবাদী প্রকল্প তৈরির চেষ্টা করেছিলো, সম্ভবত প্রকাশ্যভাবে দেশের পূর্ব এবং পশ্চিম অংশকে একত্রিত করতে পারে এমন একটা সমষ্টিগত অনুভূতির ধারণা তৈরি করতেই এই সিদ্ধান্ত। বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে এবং উর্দুর পক্ষে জিন্নার যুক্তি ছিল যে, বাংলা ভাষা ইসলামের ধর্মীয় সংস্কৃতির সঙ্গে মেলে না, কারণ বাংলা ভাষা প্রাচীন সংস্কৃত ভাষা থেকে উৎপন্ন এবং সংস্কৃত ভাষা সনাতন ধর্মীয় দেব ভাষা তথা জীবন দর্শন এবং সাংস্কৃতিক ধ্যানধারণার সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই সময়ে, আনুমানিক হিন্দু জনসংখ্যা অনুমান করা হয়েছিলো ১ কোটি থেকে ১ কোটি কুড়ি লক্ষের মত; মুসলমান জনসংখ্যা আনুমানিক ৩ কোটি কুড়ি লক্ষের মত; (লামবার্ট ১৯৫০, স্টেটম্যান ১৯৫১)। সুতরাং, উর্দুকে প্রচলিত ভাষা হিসাবে চিহ্নিত করা (লিঙ্গুয়া ফ্র্যাঙ্কা) ছিল পূর্ব বাংলার জাতীয়তাবাদে অনুভূত হুমকির বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া। উর্দু ভাষাকে জাতীয় ভাষা তৈরির জিন্নাহ -এর উদ্যোগটি হিন্দুদের একটি সম্প্রদায় হিসাবে পূর্ববাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের থেকে পৃথক হিসাবে চিহ্নিত করার একটি স্পষ্ট প্রচেষ্টা হিসাবে বোঝা যায়। ১৯৪৮ সালে উর্দুর বিরুদ্ধে সংগ্রাম ছাড়াও, জিন্নার দ্বারা ১৯৪৯ সালে সংস্কৃত দেবনাগরী হরফের বাংলা লিপির পরিবর্তে আরবি লিপি চালু করার চেষ্টা করা হয়েছিলো। কিন্তু স্বভাবতই বাংলার মানুষ তা মেনে নেয়নি এবং রক্তাক্ত ভাষা আন্দোলন শুরু হয়।
১৯৬৫ সালে কাশ্মির প্রশ্নে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সংগঠিত যুদ্ধে পাকিস্তান শোচনীয়ভাবে হেরে গেলে যুদ্ধের অর্থনৈতিক ক্ষতি পাকিস্তানী হিন্দুদের কাছ থেকে উশুল করার জন্য একই বছরের ৬ সেপ্টেম্বর তৎকালীন পাকিস্তান সরকার The Defence of Pakistan Ordinance, 1965” জারি করে। এর ১৬৯ বিধি মোতাবেক তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের যেসব নাগরিক ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর তারিখের পূর্ব থেকে ভারতে অবস্থানরত ছিলেন এবং যারা ওই তারিখ হতে ১৯৬৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ভারতে চলে গিয়েছিলেন তাদের যাবতীয় সম্পত্তি শত্রু সম্পত্তি হিসাবে গণ্য হয়। ১৯৬৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৫ সালের অধ্যাদেশ বাতিল করা হলেও Enemy Property (Continuance of Emergency Provisions) Ordinance, 1969 (Ord. No. I of 1969) এর মাধ্যমে শত্রু সম্পত্তি সংক্রান্ত বিধান জিইয়ে রাখা হয়।
১৯৭১ এ যুদ্ধ শুরু হবার প্রথম মুহুর্ত থেকেই ধর্মীয় পরিচয় ছিলো হত্যাযজ্ঞের টার্গেট। প্রথমেই জগন্নাথ হলে গণহত্যা চালানো হয়। খুন করা হয় অসংখ্য নিরীহ হিন্দু ছাত্রদের। মধুর ক্যান্টিনের মধু দা সহ তাঁর পরিবারকে খুন করে পাকিস্থানি হানাদাররা। নরকের কীটরা হত্যা করে গোবিন্দ চন্দ্র দেব (দর্শনশাস্ত্র), জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা (ইংরেজি সাহিত্য), অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য (ফলিত পদার্থবিদ্যা), সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য (ইতিহাস), সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য (ইতিহাস), শ্রী সুখারঞ্জন সমাদ্দার (সংস্কৃত) সহ প্রমুখ দেশ সেরা শিক্ষকদের।
পুরো নয় মাস ধরে হিন্দু ধর্মালম্বীদের উপর নির্বিচারে লুট, ডাকাতি, অগ্নিসংযোগ, হত্যা, নারী-নির্যাতন করে পাকিস্থানী সেনাবাহিনী আর তাদের এদেশীয় সহযোগীরা।
মহান স্বাধীনতার যুদ্ধে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব সম্প্রদায়ের মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অংশগ্রহণ করেছেন। তবে মুক্তিযুদ্ধে হিন্দু সম্প্রদায়ের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অন্য সব সম্প্রদায়ের চাইতে বেশি ছিলো এটাই বাস্তবতা। বহু হিন্দু পরিবার আছে যারা সব কিছুই হারিয়েছেন। বিপুল সংখ্যক হিন্দু ভারতের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে অকাল মৃত্যুবরণ করেছেন। কেনেডি রিপোর্ট অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্তদের ৮০% ছিলেন হিন্দু। নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হিন্দুদের টার্গেট করা হয়েছিলো, হিন্দু বাড়িতে ‘এইচ’ চিহ্নে চিহ্নিত করা হয়েছিলো। স্বাধীনতা পরবর্তী আজ পর্যন্ত এসব অগণিত নিহত ও নিখোঁজ হিন্দুদের অনুসন্ধান, স্মরণ কোনো কিছুই রাষ্ট্রীয়ভাবে করা হয় নাই।
মার্কিন সেনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় হিন্দুদের লক্ষ্যবস্তু করা সম্পর্কে মার্কিন সংসদে মন্তব্য করেছিলেন: "মার্কিন সরকারকে আনুষ্ঠানিক প্রতিবেদন যা অগণিত প্রত্যক্ষদর্শী, সাংবাদিকতার বিবরণী, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির প্রতিবেদনে পূর্ববাংলার (বা পূর্ব পাকিস্তান) দখলকারীদের সন্ত্রাসবাদী রাজত্বের দলিল পেশ করে। ....পূর্ববঙ্গে সবচেয়ে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যরা যাঁদের গৃহ, জমি এবং দোকানগুলি স্থানীয় মুসলিম সন্ত্রাসবাদীরা ছিনতাই করেছে, নিয়মিতভাবে হিন্দুদের জবাই করেছে, হিন্দু মহিলাদের, শিশু কন্যাদের লুন্ঠন করেছে এবং অত্যচার করেছে এবং সমস্ত হিন্দুদের বাড়ির দরজায় হলুদ রঙে "এইচ" (হিন্দু বাড়ি বোঝানোর জন্য) চিহ্ন আঁকা হয়েছিল। এগুলি সবই যদিও ইসলামাবাদ থেকে প্রচ্ছন্নভাবে আনুষ্ঠানিকভাবে সামরিক আইনে অনুমোদিত, আদেশ ও প্রয়োগ বলে করা হয়েছে (লিন্টনার ২০০৩: ২)।
প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যলয়ের রাজনীতি এবং আন্তর্জাতিক বিষয়ের অধ্যাপক গ্যারি জে বাস তার সম্প্রতি প্রকাশিত “ দি ব্ল্যাড টেলিগ্রাম : নিক্সন কিসিঞ্জার অ্যান্ড এ ফরগটন জেনোসাইড ” বইতে লিখেছেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বাংলাদেশের প্রায় এক লাখ হিন্দুকে নির্বিচারে খুন করেছিলো।
আইন ও শালিস কেন্দ্র ’৯৫ সালে প্রকাশ করে যে মোট সম্পত্তির ৭২% বিএনপির লোকজনের গ্রাসে গেছে, যদিও ’৮৮ সালে ৪৪% আওয়ামী লোকদের ভাগে ও ৩২% বিএনপির ভাগে ছিল, জাতীয় পার্টি জামাতও পিছিয়ে নেই। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাত ’৯৭ সালে 'Inquiry into Causes and Consequences of Deprivation of Hindu Minorities in Bangladesh through the Vested Property Act' নামের একটি গবেষনা মূলক গ্রন্থে । উনার গবেষণা অনুযায়ী, এ আইনের ফলে সারা দেশে মোট ২৭লাখ হিন্দুখানার মধ্যে ১২ লাখ (শতকরা ৪৪ ভাগ) খানা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর ভূমিচ্যুতির পরিমাণ ২৬ লাখ একর। যা মোট মালিকানার ৪৫ ভাগ। ক্ষতিগ্রস্ত ২৬ লাখ একরের মধ্যে ৮১ ভাগ কৃষি জমি, ১১ ভাগ বসতভিটা, ২ ভাগ পুকুর, ১ ভাগ পতিত জমি। এসব জমির বাজার মূল্য (২০০৭ সালের বাজার মূল্যে) ৩ লাখ ১০ হাজার ৬৬৪ কোটি টাকা।
‘Deprivation of Hindu Minority in Bangladesh: Living with Vested Property’-শিরোনামে একটি বই পাঠক সমাবেশ থেকে বের হয়েছিল ২০০৮ সালে। বইটি যৌথভাবে লিখেছেন, অর্থনীতিবিদ আবুল বারাকাত এবং অন্যরা। গবেষণামূলক এ বইটিতে লেখকবৃন্দ দেখিয়েছেন শত্রু সম্পত্তি আইনের ফলে ১৯৬৫-২০০৬ সময়কালে ১২ লক্ষ পরিবারের ৬০ লাখ হিন্দু জনগোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ওই সময়কালে হিন্দু সম্প্রদায় ২৬ লাখ একর ভূমি হারিয়েছে এবং অনেক পরিবার সব হারিয়ে সর্বশান্ত হয়েছেন।
এ পর্যন্ত সার্বিকভাবে কি পরিমাণ নির্যাতন, অত্যাচার সনাতনীদের উপর হয়েছে তার একটা চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছি মাত্র। যে দেশে এখনো সঠিক মুক্তিযোদ্ধার তালিকা তৈরি হয়নি সেই দেশে মুক্তিযোদ্ধা এবং নির্যাতিত সনাতনীদের তালিকা পাবার আশা দূর অস্ত। যদি আমরা আমাদের নিজেদের এলাকার তালিকা নিজেদের উদ্যোগে করতে পারি তাহলে হয়তো কিছু নাম এখনো পাওয়া যেতে পারে।
এই মুহুর্তে যেসব ব্যক্তিদের নাম এবং স্থানের ঘটনা হাতের কাছে আছে সেগুলোর একটা তালিকা নীচে দিচ্ছি
(১) তেসরা মার্চ, ১৯৭১ যশোরে পাকিস্থানি সেনাবাহিনীর হাতে প্রথম শহীদ হন গৃহবধু চারুবালা কর।যশোর নীলগঞ্জ শ্মশানে তাঁর সমাধিটা পর্যন্ত বেদখল হয়ে আছে।
(২)২৫মার্চ কালো রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় জগন্নাথ হলে নিরীহ হিন্দু ছাত্রদের নির্বিচারে খুন করে পাকিস্থানি সেনাবাহিনী। একই সাথে খুন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক প্রথিতযশা শিক্ষকদের। এই সব শিক্ষকদের একটি বড় অংশ সনাতনী সম্প্রদায়ের। মধুর ক্যান্টিনের মধু দা’কে পুরো পরিবারসহ খুন করে নরকের কীট গুলো।
(৩) ২৫ মার্চ রাত থেকেই পুরান ঢাকার হিন্দুদের উপর নেমে আসে অত্যাচার আর খুনের খড়্গ। মগবাজারে পাল পাড়ায় একই ভাবে নরক নেমে আসে।
(৪) কুমিল্লায় ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত যাকে রাজনীতিতে নিস্ক্রিয় করে রাখা হয়েছিলো সনাতনী হবার অপরাধে তাঁকে তাঁর পুত্র সহ কুমিল্লা ক্যান্টমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানেই পাকি সেনারা নির্মমভাবে তাঁদের খুন করে।
(৫) রমনা কালী মন্দির গুড়িয়ে দেয় পাকি শয়তানের দল
(৬) খুলনা ডুমুরিয়া চুকনগরে গণহত্যায় মেতে ওঠে পাকি সেনারা। ১৯৭১ সালের ২০ মে প্রায় ৩০-৪০ হাজার মানুষ প্রাণ বাঁচাতে ভারতের যাওয়ার জন্য সেখানে জড়ো হচ্ছিল। এই খবর দেশীয় রাজাকারদের মাধ্যমে পাক হানাদার বাহিনীর কাছে যায়। পাকি সেনাবাহিনী সেখানে নৃশংস গনহত্যা চালায়। পাকি মিলিটারিরা সেখানে এসেই নিরীহ ব্যক্তিদের উপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। এতে করে সেখানে প্রায় ৮-১০ হাজার ব্যক্তি প্রাণ হারান! এবং গুলি করে মারার পর পাক বাহিনী মৃতদেহগুলোকে জলে ফেলে দেয়। সেসব লাশ আটখিলা ইউনিয়নের পাতাখোলা বিল থেকে ভদ্রা নদী এবং সাতক্ষীরা রোড থেকে ঘাংরাইল নদী পর্যন্ত ভাসতে থাকে। পাক বাহিনী কর্তৃক নদীতে নিক্ষেপিত লাশের সংখ্যা এত বেশি ছিল যে ভদ্রা নদীর স্রোত রুদ্ধ হয়ে পড়ে লাশ বহরের কারণে!বলা বাহুল্য সেদিন শহীদ বেশিরভাগ ব্যক্তিই ছিলো সনাতনী।
(৭) ভারতে যাবার পথে অগণিত সনাতনীকে জীবন দিতে হয়েছে রাজাকার আর পাকি সেনাদের হাতে। সর্বস্ব খোয়াতে হয়েছে এদের কাছে। নারী নির্যাতন দুনিয়ার যেকোন যুদ্ধের চেয়ে বেশি মাত্রায় করেছে পাকিরা আর তাঁদের সহযোগীরা।
(৮) ১৯৭১ সালের ৯ এপ্রিল ঢাকার অদুরে ধামরাইতে গণহত্যা করে পাকিস্থানিরা। সেখানকার কায়েত পাড়াসহ হিন্দু সম্প্রদায়অধ্যুষিত গ্রামগুলো থেকে লোকজনকে আটক করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এরপর তাদেরকে বংশী নদীর পাড়ে নিয়ে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি চালায়।
(৯) জগৎজ্যোতি দাস। হবিগঞ্জে দাস পার্টির কর্ণধার। সুরঞ্জিত সেন গুপ্তের কমান্ডের অধীনে ছিলেন তিনি। তাঁর দাস পার্টিতে আরো কয়েকজন সনাতনী ছিলেন। তিনি সম্মুখ যুদ্ধে নিহত হন। তাঁর অসীম সাহসিকতায় কয়েকজন সহযোদ্ধা বেঁচে যান। এবং ১২ জন পাকি সেনাকে গুলি করে খতম করেন। বিস্তারিত জানতে হাসান মোরশেদ এর লেখা “দাস পার্টির খোঁজে” বইটা পড়তে পারেন। তাঁকে সর্বোচ্চ সম্মান দেবার কথা দিলেও বাংলাদেশ সরকার বীর বিক্রম উপাধি দিয়ে দায় মিটিয়েছে।
(১০) চট্টগ্রাম, কুমিল্লা সহ সারা বাংলাদেশেই বিহারী, রাজাকার, পাকিস্থানীদের দ্বারা সনাতনীরা খুন, লুট, নির্যাতনের স্বীকার হয়েছে। যে কোনো স্থানের শহীদের তালিকা দেখলেই সেখানে সনাতনীদের সংখ্যাধিক্য চোখে পড়ার মতো। সারা দেশের হিন্দু পাড়া, মহল্লার পাশাপাশি এমন কোন মঠ মন্দির ছিল না যা পাক হানাদার বাহিনীর হাতে ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি। সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় এসব ক্ষতিগ্রস্থ মন্দির গুলি পূণর্গঠনের কোনো কাজ হয়েছে বলে জানা নেই। যুদ্ধের সময় খুলনা অঞ্চলে সীমান্তের ২০ মাইল পথ ঘুরে দেখার যে অভিজ্ঞতা মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি লিখেছিলেন, তাতেও শরণার্থীরা যে মূলত হিন্দু ধর্মাবলম্বীই ছিল, তা জানা যায়। 'দ্য টেস্টিমনি অব সিক্সটি'তে কেনেডি লিখেছিলেন, 'যেদিন আমরা এই ২০ মাইল সড়ক ঘুরি, সেদিন কমপক্ষে সাত হাজার শরণার্থী বয়রার কাছে নদী পেরিয়ে সীমান্তের পাড়ঘেঁষে স্রোতধারার মতো নেমে এসেছে। এদের প্রায় সবাই কৃষক, চাষি-মজুর। অধিকাংশই হিন্দু। ঢাকা জেলার দক্ষিণে খুলনা ও বরিশাল থেকে এসেছে। গত শরতের সাইক্লোনে বিধ্বস্ত প্রান্তবর্তী জেলা থেকে এসেছে।' কেনেডি একাত্তরের আগস্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ভারত এসেছিলেন এবং পাঁচ দিন পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরাসহ অন্যান্য রাজ্যে শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন। 'দ্য টেস্টিমনি অব সিক্সটি' প্রকাশিত হয় অক্টোবরে। ততদিনে ভারতে শরণার্থীর সংখ্যা ৯০ লাখ হয়ে গিয়েছিলো।
(১১) শিব নারায়ণ দাস এঁর কথা উল্লেখ করতে চাই যিনি আমাদের পতাকা তৈরিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলেন।
(১২) বিশেষভাবে বলতে চাই ভাগীরথী সাহা এঁর কথা। পিরোজপুরের পাশের জেলা বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার দেবীপুর গ্রামে ভাগীরথীর জন্ম ১৯৪০ সালে। বাবা মুড়ি বিক্রি করতেন। স্কুলে পড়ার সুযোগ হয়নি ভাগীরথীর। ১৯৫৬ সালে বিয়ে হয়েছিল পিরোজপুর জেলার বাগমারা গ্রামের প্রিয়নাথ সাহার সঙ্গে। ১৯৬৭ সালে দুই শিশু সন্তান নিয়ে মাত্র ২৭ বছর বয়সে বিধবা হন ভাগীরথী। দিনটি ছিল ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১। সেদিন পিরোজপুর শহরের পিচঢালা কালোপথ লাল হয়েছিলো শহীদ ভাগীরথীর তাজা রক্তে। মুক্তিযোদ্ধাদের চর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের দোসরদের গতিবিধির উপর নজর রাখার। অন্ততঃ ২বার তিনি পাকি সেনাদের মিস গাইড করে মুক্তি যোদ্ধাদের হাতে তুলে দিয়েছেন। ২৯ আগস্ট এবং ৮ ও ৯ সেপ্টেম্বরের অপারেশনে মোট ৫০-৬০ জন পাকি সেনা ভব লীলা সাঙ্গ করে। পরবর্তীতে পাকিরা তাঁকে ধরে ফেলে এবং নৃশংস উপায়ে তাঁকে হত্যা করে। দেশের জন্য সর্বোচ্চ আত্মদানকারী এই নারীর জন্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়নি তেমন কোন উদ্যোগ। পিরোজপুর শহরে স্থাপিত শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে ভাগীরথীর নাম রয়েছে চতুর্থ স্থানে। আর শহরের কৃষ্ণচূড়া মোড়টিতে তার নামে রয়েছে একটি ফলক। দুই ছেলেকে রাস্তার ধারে শুইয়ে রেখে পাকিস্তানী ক্যাম্পে গিয়েছিলেন মা। বড় ছেলে কার্তিক পরবর্তী সময়ে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা যান। ৬০ বছর বয়সী ছোট ছেলে গণেশ সাহা এখনও বেঁচে আছেন। দিনমজুরের কাজ করেন। আর মায়ের মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ের স্বীকৃতি আদায় করতে দরজায় দরজায় ঘুরে চলেছেন আজও।
(১৩) বর্তমানে পিরোজপুর জেলার (তৎকালীন পিরোজপুর মহাকুমা) মঠবাড়িয়া উপজেলার সূর্যমনি এবং আঙ্গুলকাট গ্রামে ১৯৭১ এর ৭ অক্টোবর ভোরে গণহত্যা চালায় পাকিস্থানি সেনারা। আনুমানিক ২৫ জন সনাতনী সেদিন নিহত হন। মেয়েদের উপর চালানো হয় নির্যাতন।
(১৪) গোবিন্দ চন্দ্র দেব (দর্শনশাস্ত্র), জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা (ইংরেজি সাহিত্য), অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য (ফলিত পদার্থবিদ্যা), সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য (ইতিহাস), শ্রী সুখরঞ্জন সমাদ্দার (সংস্কৃত), এস কে লালা, হেমচন্দ্র বসাক, রণদাপ্রসাদ সাহা (সমাজসেবক এবং দানবীর), যোগেশচন্দ্র ঘোষ (শিক্ষাবিদ, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক), নূতন চন্দ্র সিংহ (সমাজসেবক, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক, চট্টগ্রাম), শহীদ নীলমনি সরকার (বীর বিক্রম)
(১৫) বীর উত্তম সি আর দত্ত, বীরপ্রতীক মেজর অলিক কুমার দত্ত, বীরপ্রতীক দেবদাস বিশ্বাস (খোকন)
(১৬) স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলে ছিলেন অমলেশ সেন, প্রতাপ শঙ্কর হাজরা, বিমল কর, সুভাষ সাহা, প্রাণগোবিন্দ কুন্ডু, নিহার কান্তি দাস ও কোচ নন্দী বসাক। যুদ্ধের সময় ভারতের বিভিন্ন স্থানে প্রীতি ম্যাচ খেলেছেন আর যুদ্ধের জন্য তহবিল সংগ্রহ করেছেন।
(১৭) স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ছিলেন গোবিন্দ হালদার, সুজেয় শ্যাম, গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার, অংশুমান রায়, সমর দাস, ইন্দ্রমোহন রাজবংশী, শেফালি ঘোষ, রবীন্দ্রনাথ রায়, কল্যাণী ঘোষ, সুজিত রায়, মনোরঞ্জন ঘোষাল, তিমির নন্দী, নমিতা ঘোষ, ডঃ এ আর মল্লিক, কল্যাণ মিত্র, মহাদেব সাহা, নির্মলেন্দু গুণ, রথীন্দ্রনাথ রায়, ডাঃ অরূপ রতন চৌধুরী, সমর দাস, অজিত রায়, শাহীন কল্যাণী ঘোষ, মিতালী মুখার্জী।
(১৮) যেসব সনাতনীরা বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছিলো, স্বাধীনতার পর তাদের বেশিরভাগ পরিবার বাড়ি এসে মাটি ছাড়া কিছু পায় নাই।
(১৯) এছাড়া ভারতীয় রাজনীতিবিদ, সাংস্কৃতিক কর্মী সহ ভারতের আম জনতার যে সাপোর্ট বাংলাদেশের প্রতি ছিলো তা ছিলো অনন্য, নজির বিহীন।
(২০) এই সুযোগে মিত্র বাহিনীর সেই সব সেনাদের স্মরণ করতে চাই যারা বীরগতি প্রাপ্ত হয়েছিলেন, যারা আহত হয়েছিলেন, এবং বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন। আমি আরো স্মরণ করতে চাই তিব্বতি সেই সব বীরদের যারা বেনামে আমাদের যুদ্ধে আমাদের সাথে সামিল হয়েছিলেন। স্মরণ করতে চাই নেপাল কংগ্রেস কে যারা অস্ত্র দিয়ে আমাদের সহায়তা করেছিলেন।
আপাততঃ এটুকুই থাক। পরবর্তীতে এটি বিস্তারিত লেখার আশা রাখি।
সবাইকে নমস্কার।
২৫ মার্চ ২০২২
যার ঝাড়ে বংশে কেও মুক্তিযুদ্ধ করে নাই, জাতীয় সংগীত গায় না, শহীদ মিনারে যায় না, স্মৃতি সৌধে যায় না, পয়লা বৈশাখ যার কাছে শিরক, যারা সংবিধান মানে না, বঙ্গবন্ধুকে মানে না, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলে, যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সংবিধানের ৪ স্তম্ভ মানে না - আমরা তাদের ভোটাধিকার রহিত করি নাই, আমরা তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করি নাই কেনো??

