সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

যুক্তিফাঁদে ফড়িং - চমক হাসান

ডিসক্লেইমারঃ
চমক হাসানের লেখা অসাধারণ একটা বই এটি। খুব সহজভাবে যুক্তি, ভ্রান্তি নিয়ে লেখা যা প্রতিটি হিন্দু তথা সকল মুক্তবুদ্ধির মানুষের জন্য অবশ্যপাঠ্য। এখানে এই বইটি উম্মুক্ত করা হয়েছে শুধুমাত্র বাংলাদেশের পরিস্থিতি বিবেচনা করে। 
চারিদিকে সাম্প্রদায়িক শক্তির হুংকার দেখা যাচ্ছে। তারা তাদের বিষাক্ত নখ, দাঁত দিয়ে বাংলাদেশকে প্রতিনিয়ত ক্ষত বিক্ষত করছে। এই সাম্প্রদায়িক শক্তি যেসব অস্ত্র দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে তার একটি বড় অস্ত্র হলো এই ভ্রান্তি'র ব্যবহার। ইংরেজিতে যাকে ফ্যালাসি বলে। এটা পড়লে মোটা দাগে কোনটা সুযুক্তি আর কোনটা কুযুক্তি সেটা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পাবেন। 
[চমক হাসান ভাই যদি কোনোদিন এই সাইট দেখেন, আপনার ঔদার্যের গুণে ক্ষমা করবেন।]

গল্প শুরুর আগে
ভ্রান্তি চারিদিকে

আন্তনগর মধুমতী এক্সপ্রেস ট্রেনের ভেতরে বসে আছে হাসিব, গন্তব্য 'খোকসা'। ঢাকা থেকে বাসে করে আসা যেত, তাতে সময় অনেক কম লাগত। তবু সে ট্রেনেই আসবে ঠিক করেছিল। ট্রেনে চড়লে নাকি একটা আয়েশি ভাব আসে ওর, ট্রেনের ছন্দ আর দুলুনিতে মনটা খুশি খুশি লাগে। তা ছাড়া স্টেশনে স্টেশনে মানুষের ওঠানামা দেখতে ভালো লাগে। আর নানা রকম মানুষের নানা রকম কথা শোনাটাও একটা বিনোদনের মতো। এসব ভাবতে ভাবতেই একটা চেঁচামেচি কানে আসে ওর।

পেছনে তাকিয়ে দেখে বেশ অভিজাত জামা-জুতো পরা কেতাদুরস্ত একজন মানুষ গলা উঁচিয়ে ঝাড়ি দিচ্ছে লুঙ্গি আর ছেঁড়া শার্ট পরা একজন মানুষকে।

আমি ব্যাগ কোথায় রাখব সেটা তুই বলার কে? যতসব চাষাভূষা- মূর্খ লোকজন আমাকে ঠিক-বেঠিক শেখাতে আসছে!'

কথাবার্তা শুনে বোঝা গেল, কেতাদুরস্ত লোকটা ব্যাগ রেখেছিল ট্রেনের কামরার রাস্তার মাঝখানে। ছেঁড়া জামা পরা লোকটা বলেছিল ওটা পাশে সরিয়ে রাখতে যেন মানুষের চলাচলে সমস্যা না হয়। ব্যাগ সরিয়ে রাখাটাই ঠিক ছিল, অথচ বেচারা ঠিক কথাটা বলতে গিয়ে ঝাড়ি খেল। হাসিব মনে মনে বলল, 'Ad Hominem ! অপ্রাসঙ্গিক ব্যক্তি আক্রমণ। ব্যাগ রাস্তায় রাখা যাবে না— এই কমনসেন্সের জন্য ছেঁড়া জামা কিংবা চাষাভূষা হওয়ার কোনো সংযোগ নেই। এখানে যেটা হয়েছে, সেটা একটা Logical Fallacy। যুক্তির ভ্রান্তি।'

সামনের সিটে একটা ছোট মেয়ে বসে ছিল তার মায়ের সঙ্গে। মেয়েটাও চেঁচামেচি শুনেছে। সে তার মাকে জিজ্ঞেস করল, মা, এভাবে কথা বলাটা কি ঠিক? মা বলল, 'আম্মু, তুমি ঠিকমতো লেখাপড়া করো, বড় হও, তখন ঠিক-বেঠিক বুঝতে পারবে।' হাসিব মনে মনে হাসে, ‘এখানেও ফ্যালাসি - Red Herring! প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দেওয়া। মেয়ের প্রশ্ন ছিল, লোকটার আচরণ ঠিক না বেঠিক সেটা নিয়ে। মা সেটার উত্তর না দিয়ে লেখাপড়ায় ঢুকে গেছেন। এখানেও একটা ফ্যালাসি ঘটেছে।

হাসিবের মাথার ভেতরে যুক্তির ভ্রান্তিগুলো ঘুরতে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বিতর্ক করতে সে দারুণ ভালোবাসত। এই যুক্তির ভ্রান্তিগুলো তখন মাথায় রাখাটা খুব জরুরি ছিল। এগুলো অবশ্য এখনো জরুরি। জীবনে চলতে-ফিরতে কত জায়গায়ই না এসব দেখা যায়! এগুলো থেকে সতর্ক হওয়াটা দরকার।

চেঁচামেচি কমে এসেছে। হাসিব জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। ট্রেনের গতি কমছে। দূরে দেখা যায় কুমারখালী রেলস্টেশন, ওখানে এখন থামবে তার ট্রেন। আর এর পরের স্টেশনেই ওকে নামতে হবে। খোকসা। ওর শৈশবের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে থাকা খোকসা।

নতুন জীবনের পথে

খোকসা রেলস্টেশনে নেমে কিছুদূর এগোতেই স্কুলের নামটা চোখে পড়ে হাসিবের— 'শোমসপুর উচ্চবিদ্যালয়'। আগামী কয়েকটা মাস কিংবা হয়তো কয়েকটা বছর এই স্কুলে শিক্ষকতা করেই কাটবে তার। হাসিবের বাবা-মা কেউই তার এই পাগলামিতে খুব একটা খুশি নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এত ভালো ফল নিয়ে পাস করে কেউ গ্রামের স্কুলে মাস্টারি করতে যায়?

'বিসিএস দিতে পারতি। সরকারি চাকরি ভালো না লাগলে একটা বেসরকারি চাকরি নিতি! বৃত্তি নিয়ে বাইরে লেখাপড়া করতি, তাই বলে গ্রামের স্কুলে মাস্টারি?'

‘এভাবে গ্রাম কেন বলছ? শোমসপুর কি এখন আর সেই অজপাড়াগাঁ আছে? ইন্টারনেট আছে, ডিশ লাইন আছে। লোডশেডিংও খুব একটা হয় না। আর আমি তো সারা জীবনের জন্য যাচ্ছি না। কয়েকটা মাস মাটির খুব কাছাকাছি থাকার এই অভিজ্ঞতাটা আমি চাই।' মা- বাবাকে হাসিব বোঝানোর চেষ্টা করেছে অনেক। তারা বোঝেননি।

মা-বাবার গোমড়া মুখের কথা ভেবে এখন হাসি পায় হাসিবের। ছাত্রজীবনে বিতার্কিক হিসেবে পরিচিতি ছিল। যুক্তির ঘায়ে কতজনকে কুপোকাত করেছে কতবার। কিন্তু বাবা-মায়ের কাছে এসে সে বারবার হেরে যায়। কী জানি! কিছু কিছু সময় হয়তো হারতেই ভালো লাগে।

দ্রুত পা বাড়িয়ে রহমত চাচার বাড়ির দিকে এগোয় ও। ওই বাড়িতেই থাকার বন্দোবস্ত হয়েছে। আগামীকাল থেকে তার সংক্ষিপ্ত বেকার জীবনের ইতি ঘটতে চলেছে। এখন থেকে তার পরিচয় হবে অঙ্ক- বিজ্ঞানের মাস্টার হিসেবে- এটা ভেবে হাসিবের হাসি পায়!

যেটা হাসিব জানত না তা হলো, এই স্কুলে ওর যে আনন্দময় স্মৃতিগুলো তৈরি হবে, সেগুলোতে অঙ্ক-বিজ্ঞানের জায়গা কমই থাকবে। ওর সুন্দর মুহূর্তগুলো কাটবে বরং যুক্তির সঙ্গে, যুক্তির ভ্রান্তির সঙ্গে।

যুক্তি আর ভ্রান্তির প্রথম পাঠ:

শোমসপুর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক রফিকুল সাহেব হাসিবের বাবার বন্ধু ছিলেন। হাসিবকে শিক্ষক হিসেবে পেয়ে তিনি খুব খুশি। হাসিবকে ডেকে সন্তানয়েহে অনেক কিছু বুঝিয়ে দিলেন। ওকে দেওয়া হলো অষ্টম, নবম আর দশম শ্রেণির ক্লাস। গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নের অনেক ক্লাসই ওকে নিতে হবে। অন্য সবার সঙ্গে কথা বলে হাসিব বুঝতে পারল, হাইস্কুলের কাজের চাপ আসলে ও যা ভেবেছিল তার চেয়ে অনেক বেশি।

প্রথম দুটো ক্লাস বেশ মসৃণভাবে নেওয়ার পর তৃতীয় ক্লাসে গিয়ে ও মূল প্রসঙ্গ থেকে বেশ দূরে সরে গেল।

ক্লাসে অঙ্ক শেখাচ্ছিল হাসিব। একটা অঙ্ক শিখিয়ে আরেকটা সবাইকে করতে দেয়। সময় দেয় পাঁচ মিনিট। ঠিক করেছিল সময় শেষ হয়ে গেলে ও দুই-তিনজনের খাতা দেখবে। এমন সময় হুট করে হাসিবের মাথায় একটা চিন্তা আসে: দুই-তিনজনের খাতা দেখেই কি বোঝা যাবে 'সবাই' শিখেছে নাকি? অল্প নমুনা দেখে বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলা সব সময় যৌক্তিক নয়। 'Hasty Generalization' বলে একটা ফ্যালাসি আছে। যা হোক, পরে ভাবা যাবে। ভাবনার জন্য বিষয়টা আপাতত তুলে রাখে।

পাঁচ মিনিট সময় শেষ। হাসিব ইচ্ছেমতো একজনের খাতা টেনে নেয়। হাসিব জানে উত্তর হওয়ার কথা শূন্য। সেই ছাত্রের উত্তরও এসেছে শূন্য। কিন্তু হাসিব দেখে, ছাত্রটা অনেক গোঁজামিল দিয়ে শেষ পর্যন্ত উত্তর মিলিয়ে দিয়েছে। হাসিবের হাসি পায়। ওর মনে হয় ছাত্রছাত্রীদের এবার একটু জ্ঞান দেওয়া দরকার। হেঁটে হেঁটে ও বোর্ডের কাছে যায়, ছাত্রছাত্রীদের দিকে ঘুরে মুখ হাসি হাসি রেখে বলে,

বলো তো, আমরা যখন অঙ্ক করি, তখন কোনটা বেশি জরুরি, উত্তরটা নাকি পদ্ধতিটা?

ছেলেমেয়েরা একটু দ্বিধান্বিত হয়ে যায়। অঙ্ক ঠিকমতো করেও যদি ছোট ভুলের কারণে উত্তরটা ভুল আসে, স্যাররা সব নম্বর কেটে রাখেন। এ থেকে ওদের মনে হয় উত্তরটাই বেশি জরুরি।

হাসিব ছাত্রছাত্রীদের দ্বিধাটা টের পায়। তারপরে বলে,

উত্তর অবশ্যই জরুরি। তবে গণিতে পদ্ধতিটা আরও বেশি জরুরি। অনেক সময় ভুল চিন্তা থেকেও ঠিক উত্তর আসতে পারে। মনে করো, আমি কাউকে জিজ্ঞেস করলাম ৫ দুগুণে কত হয়। সে উত্তর দিল এভাবে।

১ আর ৪ যোগ দিলে ৫ হয়।

৭ আর ৩ যোগ দিলে হয় ১০।

তাহলে আমার মনে হয় ৫ দুগুণে ১০ হবে।

তোমাদের কী মনে হয়, এটা কি ঠিক হলো? উঁচু। দেখো, এখানে তিনটা বাক্যের কোনোটাই ভুল না। কিন্তু ভুলটা হলো যুক্তি গঠনে। প্রথম দুই লাইন থেকে শেষ লাইন কী করে এল, কেউ জানে না। অঙ্কের ফল ঠিক এসেছে কিন্তু সেটাই সব কথা নয়। কোন পথ ধরে এল, সেটা খুব জরুরি।

আজকের ক্লাসে তোমাদের আর গণিত শেখাব না, তোমাদের একটু যুক্তি শেখানো যাক। তোমরা কি রাজি?

সবাই একবাক্যে বলল, 'জি স্যার'। অঙ্কের ক্লাসে স্যার আর অঙ্ক করাতে চান না, এটাতে সবাইকে বেশ খুশি মনে হলো। হাসিব বোর্ডটা পরিষ্কার করে লিখল 'যুক্তিবিদ্যা'।

যুক্তি (ARGUMENT)

গণিতে, বিজ্ঞানে কিংবা রাস্তাঘাটে, চায়ের দোকানে তর্কে-বিতর্কে মানুষ সব জায়গাতেই যুক্তি প্রয়োগ করছে। এসব যুক্তির গঠন কেমন, সেগুলো কি আসলেই ঠিক যুক্তি নাকি ভুল, এমন নানা বিষয় নিয়ে ভাবা হয় যুক্তিবিদ্যায়।

যুক্তিবিদ্যা নিজেই অনেক বড় একটা বিষয়। শুধু এটা নিয়েই অনেক অনেক পড়ালেখা করা যায়। আমি অবশ্য যুক্তিবিদ্যার অনেক গভীরে যাব না। যুক্তি প্রয়োগের সময় আমরা কী ধরনের ভুল করি তার কয়েকটা তোমাদের শেখাব।

যুক্তি দেওয়ার সময় যেসব ভুল আমরা করি, সেগুলোকে বলে 'logical fallacy' বা যুক্তির ভ্রান্তি। আরেকটা গালভরা বাংলা নামও আছে এটার- 'হেত্বাভাস'। হেতু+আভাস এমন সন্ধি করে শব্দটা এসেছে। এই নামটার কথা হয়তো পরে কখনো বলব। এখন আমরা ভ্রান্তি শব্দটা ব্যবহার করব। মাঝে মাঝে সরাসরি ইংরেজি থেকে নিয়ে ফ্যালাসি শব্দটাও ব্যবহার করব।

ভুলগুলো বোঝার আগে চলো একটু যুক্তি ব্যাপারটার দিকেই তাকাই। কখনো খেয়াল করেছ কী, আমরা যখন যুক্তি দিই, সেটার কাঠামোটা কী রকম হয়?

খুব সহজ করে বললে, যুক্তি দেওয়ার সময় কিছু একটা কথার ভিত্তিতে আমরা কিছু একটা বলি। যেমন ধরো কেউ বলল, মাথাটা খুব ব্যথা, তাই স্কুলে যাব না। এখানে তার মূল কথা হলো, 'সে স্কুলে যাবে না'। এটাকে বলে 'সিদ্ধান্ত (conclusion)'। কিন্তু এই সিদ্ধান্তে সে কিসের ভিত্তিতে পৌঁছাল? 'মাথাটা খুব ব্যথা'- এই বাক্যের ভিত্তিতে, এই তথ্যের ওপর আশ্রয় করে। ওই তথাকে বলে 'আশ্রয় বাক্য (premise)'।

মাথাটা খুব ব্যথা (আশ্রয় বাক্য)

তাই স্কুলে যাব না (সিদ্ধান্ত)

আশ্রয় বাক্য একটা হতে পারে, একের বেশিও হতে পারে। যেমন খুব প্রচলিত একটা যুক্তির কথা বলা যেতে পারে,

মানুষ মরণশীল (আশ্রয় বাক্য ১)

হাফিজ একজন মানুষ (আশ্রয় বাক্য ২)

অতএব, হাফিজ একদিন মরবে (সিদ্ধান্ত)

খেয়াল করো, এখানে কিন্তু আশ্রয় বাক্য দুটো।

হাসিবের কথা শেষ হওয়ার আগেই ক্লাসের পেছন থেকে হাসির শব্দ পাওয়া যায়। হাসিব জানত না যে ওই ক্লাসে হাফিজ নামে একটা ছেলে আছে। সে দাঁড়িয়ে বলল, 'স্যার, তাই বলে যুক্তি শেখাতে গিয়ে আমাকে মেরেই ফেলবেন।' পুরো ক্লাস খিলখিল করে ওঠে।

পেছন থেকে কেউ একজন মুখ লুকিয়ে বলে, 'স্যার, হাফিজকে কিন্তু বেশি ঘাঁটায়েন না, সে আমাদের ক্লাসের বুনোকবি। আপনাকে নিয়েও যে কী লিখে ফেলবে, লুকানোর জায়গা পাবেন না।'

'আচ্ছা মাথায় থাকবে ব্যাপারটা', হাসিব একটু হেসে আবার যুক্তির জগতে ফেরে।

এই আশ্রয় বাক্য আর সিদ্ধান্ত ছাড়াও যুক্তির খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা উপাদান আছে। সেটাই আসলে যুক্তির প্রাণ। তাকে বলে 'Inference বা অনুমিতি। আশ্রয় বাক্য থেকে সিদ্ধান্তে আসার ধাপ হলো এই অনুমিতি। এটা হলো আশ্রয় বাক্য আর সিদ্ধান্তের সেতুবন্ধ!

চলো এবার যুক্তির ভুলগুলোর দিকে তাকানো যাক।

ভ্রান্তি (FALLACY)

একটু আগেই তোমাদেরকে বলেছি, মানুষ যুক্তি প্রয়োগ করার সময় নানা রকমের ভুল করে, এগুলো ইংরেজিতে বলে fallacy। এই ভুলগুলো মূলত দুই রকমের হয়।

১. Formal fallacy বা কাঠামোগত ভুল: সেখানে আশ্রয় বাক্য ঠিক থাকে কিন্তু সিদ্ধান্ত নেওয়ার পথটা ভুল হয়। যুক্তি গঠনের প্রক্রিয়াটাই এখানে ভুল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সেই পাঁচ দুগুণে দশ-এর অঙ্কটার কথা। আরেকটা ভাবতে পারো,

মেঘ না হলে বৃষ্টি হয় না (আশ্রয় বাক্য ১)

আজ বৃষ্টি হয়নি (আশ্রয় বাক্য ২)

অতএব, আজকে মেঘও হয়নি (সিদ্ধান্ত)

দেখো, এটা কিন্তু ঠিক যুক্তি নয়। বৃষ্টি হয়নি মানেই যে মেঘও হয়নি- এটা বলা যায় না। শরতের সাদা মেঘ থেকে প্রায়ই হয়তো বৃষ্টি হয় না। এখানে প্রথম দুটো বাক্য যদি ঠিকও আছে, তিন নম্বর বাক্যটা ওটা থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় না। এখানে যুক্তির কাঠামোতেই ভুল।

ভুলগুলোর আরেকটা প্রকার হলো-

২. Informal Fallacy বা আশ্রয় বাক্যের ভুল: এখানে আশ্রয় বাক্যটার ভেতরেই ঝামেলা থাকে। এই ধরনের ভুলই আসলে বেশি চোখে পড়ে। আশ্রয় বাক্যটাকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়, যেন মনে হয় আরে, উনি তো ঠিকই বলছেন, কিন্তু আশ্রয় বাক্যটার দিকে নজর দিলেই বোঝা যায়, তিনি ভুলভাবে বা বিকৃতভাবে আশ্রয় বাক্যকে উপস্থাপন করেছেন।

যেমন ধরো,

বিখ্যাত ক্রিকেটার 'ক' বলেছেন, বিজ্ঞান মানুষের জন্য অভিশাপ (আশ্রয় বাক্য)

অতএব, বিজ্ঞান থেকে দূরে থাকা উচিত (সিদ্ধান্ত)

এখানে যুক্তির গঠনে খুব একটা সমস্যা নেই। একজনের বক্তব্যের ওপর ভিত্তি করে আমরা একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাচ্ছি।

কিন্তু ঝামেলা আছে আশ্রয় বাক্যটার ভেতরে। আশ্রয় বাকাটা নিজেই গ্রহণযোগ্য কি না, সেটা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। একজন ক্রিকেটার বিজ্ঞান নিয়ে কী বলল, সেটা কেন গ্রহণযোগ্য, ব্যাপারটা পরিষ্কার না। এমন ভ্রান্তিকে বলে Appeal to questionable authority। পরবর্তী সময়ে এগুলো আরও বিস্তারিত শেখাব তোমাদের।

ঘড়ির দিকে তাকায় হাসিব। ক্লাসের সময় শেষ। সবাইকে বলে, 'আমি ঠিক করেছি আগামী ক্লাসেও অঙ্ক পড়াব না। মানুষ কী অদ্ভুত ধরনের উল্টোপাল্টা যুক্তি দেয়, সেগুলোর শোনাব তোমাদের! শুনতে চাও?'

সবাইকে বেশ খুশি মনে হয়। এমন ধরনের কথা আগে কেউ ওদের বলেনি।


মূল বিষয় রেখে কাকে আক্রমণ করছো

পরের ক্লাসে হাসিব ঢুকল কয়েকটা কাগজ নিয়ে। বিতর্ক যখন করত, ডায়াসে দাঁড়ানোর সময় হাতে কতগুলো কাগজ রাখত। সেখানে ও কী কী বিষয় নিয়ে বলবে, সেগুলো ছোট ছোট করে নোট করে রাখত। সেই অভ্যাস এখনো রয়ে গেছে। একটা কাগজ দেখে ও বলল, 'আজকে তোমাদের ভুলভাল যুক্তিসংক্রান্ত তিনটা ফ্যালাসি বোঝাব। খেয়াল করলে দেখবে এমন ভ্রান্তিগুলো হরহামেশাই দেখা যায়। তিনটাই informal fallacy, অর্থাৎ যুক্তির গঠনে ভুল নেই, কিন্তু আশ্রয় বাক্যে ঝামেলা!

আজ যে ফ্যালাসিগুলো বলব, সেখানে তোমরা খেয়াল করবে, মূল বিষয় বা মূল প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে অন্য কিছুকে আক্রমণ করা হচ্ছে!

এদের প্রথমটার নাম হলো 'Ad Hominem' বা অপ্রাসঙ্গিক ব্যক্তি আক্রমণ। এটার উদাহরণ চোখ-কান খোলা রাখলে তোমরাও হয়তো দেখতে পাবে। চলো দেখি কী করে অপ্রাসঙ্গিক ব্যক্তি আক্রমণ করে যুক্তি দেওয়ার বা ভন্ডুল করার চেষ্টা করা হয়।

ভ্রান্তির নাম AD HOMINEM- অপ্রাসঙ্গিক ব্যক্তি আক্রমণ

একটা উদাহরণ দিয়েই শুরু করা যাক। এটা আমাদের সমাজে খুবই চেনা একটা ব্যাপার যে মানুষ কোনো একটা বিষয়ে আরেকজনকে ছোট করতে গিয়ে বাপ-মাকে টেনে আনে। হয়তো বাপ-মায়ের সঙ্গে পুরো ব্যাপারটার কোনো সংযোগই নেই। এখানে যেটা করা হয়, বিনা কারণে ব্যক্তি আক্রমণ করে কুযুক্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়।

উদাহরণ ৩.১: মনে করো, একজন কৃষক এসেছে গ্রামের চেয়ারম্যানের কাছে। এসে বলল, 'চেয়ারম্যান সাহেব, এবার মনে হচ্ছে ফসলের অবস্থা ভালো না। যদি সম্ভব হয় আপনি ওপরের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন, আমাদের ত্রাণট্রান লাগতে পারে।' শুনে চেয়ারম্যান বলল, 'তুই জানি ক্যাডা? তোর বাপ তো ছিল ফকির, তাই না? ভিক্ষা করে খেত। ফকিরের ছেলে, সে আসছে আমাকে জ্ঞান দিতে- কী করব না করব। যা. ভাগ এখান থেকে।'

যদি আশ্রয় বাক্য আর সিদ্ধান্ত দিয়ে ভাগ করে লেখা যায় তাহলে চেয়ারম্যানের যুক্তি দাঁড়াবে এমন-

কৃষকের বাবা ছিল ভিক্ষুক [আশ্রয় বাক্য]

অতএব কৃষিকাজ সম্পর্কে কোনো পরামর্শ দেওয়া তার ঠিক না [সিদ্ধান্ত]

একেবারেই ভুয়া যুক্তি, তাই না? তার বাবা কে ছিল সেটা কিন্তু এখানে মোটেই কোনো জরুরি ব্যাপার না। সে একজন কৃষক, তার ফসল সম্পর্কে ভালো জ্ঞান থাকতেই পারে। এই জায়গায় অযথা বাবাকে টেনে এনে চেয়ারম্যান সাহেব যেটা করলেন, সেটা হলো অপ্রাসঙ্গিক ব্যক্তি আক্রমণ। এটা Ad hominem-এর একটা উদাহরণ।

আর একটা উদাহরণ চিন্তা করো।

উদাহরণ ৩.২: মনে করো, একজন মা তার ছোট বাচ্চাকে নিয়ে গেছে শিশু বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে। সেই ডাক্তার একজন পুরুষ। ডাক্তার বাচ্চাটাকে দেখে কিছু পরামর্শ দিলেন। পরামর্শটা মায়ের পছন্দ হলো না। সেই মা এখন বলছে, আপনি তো একজন পুরুষ। আপনি কোনো দিন মা হবেন না। বাচ্চার কী করলে ভালো হয়, সেটা আপনি কোনো দিন বুঝবেন না।

মায়ের যুক্তিটা এমন-

শিশু ডাক্তার একজন পুরুষ [আশ্রয় বাক্য]

পুরুষদের পক্ষে মা হওয়া সম্ভব না [আশ্রয় বাক্য]

সন্তানের ভালো শুধু মায়েরাই জানে [আশ্রয় বাক্য]

সুতরাং কী করলে সন্তানের ভালো হবে শিশু ডাক্তার জানে না

[সিদ্ধান্ত]

উঁহু, এই মায়ের যুক্তিও ঠিক হলো না। পুরুষ হওয়ার সঙ্গে বাচ্চার চিকিৎসাসংক্রান্ত বিষয় না বোঝার সম্পর্ক নেই। বলাই হচ্ছে, ওই চিকিৎসক একজন শিশু বিশেষজ্ঞ।

রাজনীতিতেও এ রকমের ফ্যালাসি আমরা প্রায়ই দেখে থাকি।

উদাহরণ ৩.৩: মনে করো নির্বাচনে দুইজন প্রার্থী দাঁড়িয়েছেন। একজন প্রার্থী তার নির্বাচনী বক্তব্য দেওয়ার সময় অন্য প্রার্থী সম্পর্কে বলেছেন, আপনারা দেখেন ওই প্রার্থী ঠিকমতো দুই লাইন কথাই বলতে পারে না, হাঁটতে গেলে উষ্টা খায়, সে নাকি জনগণের উন্নয়ন করবে।

কথা বলতে পারার, হাঁটার সঙ্গে উন্নয়নকাজের সরাসরি সম্পর্ক নেই। তাই এই প্রার্থী যেটা করলেন, সেটা হলো অপ্রাসঙ্গিক ব্যক্তি আক্রমণ।

এটা বলার পরপরই হাসিব পেছন থেকে হাসির আওয়াজ পায়। পেছন হেকে একজন বলে, 'স্যার, হাফিজ একটা নিয়ে এটা ছড়া লিখে ফেলেছে।'

'তাই নাকি?' মজা পায় হাসিব। 'বেশ শোনাও তাহলে-' হাফিজ একটু লজ্জা পাওয়ার ভাব নিয়ে বলে,

বললে কথা লোকে, সেই কথায় নজর দাও। 
কথা রেখে কেন শুধুই লোকটারে খোঁচাও?

ক্লাসের সবাই হাসে। ইঙ্গিতে হাফিজকে বসতে বলে হাসিব, 'বাহ। হ্যাঁ, অনেকটা অমনই।'

সতর্কতা

তবে একটা ব্যাপারে তোমাদের সতর্ক করে দিতে চাই। ব্যক্তি আক্রমণ যে করা যাবে না, এটাই কিন্তু সব সময় সত্যি নয়। যদি আক্রমণটা প্রাসঙ্গিক হয় তখন সেটা যুক্তিযুক্ত হতেও পারে। মনে করো, একটা এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে একজন চেয়ারম্যান ছিলেন, তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকবার অভিযোগ এসেছে, তিনি গম চুরি করেন।

এখন মনে করো, ওই এলাকায় একটা দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন করা হবে, যেখানে সৎ প্রার্থী খোঁজা হচ্ছে। এবার সেই কলঙ্কিত চেয়ারম্যান ওখানে প্রার্থী হতে চাইলেন। তখন আর একজন তাকে উদ্দেশ করে বললেন, 'আপনার তো গম চুরির রেকর্ড আছে, আপনি কী করে এই পদে দাঁড়াবেন?'

এমন ক্ষেত্রে এটা কিন্তু যুক্তিযুক্ত আক্রমণ হবে। এটা ফ্যালাসি নয়।

এবার চলো, আরেকটা ভ্রান্তির কথা বলি। এটাও হরহামেশা শোনা যায়। এই ফ্যালাসির নাম হলো Tu Quoque, বা বাংলায় বললে তুমিও তো!

ভ্রান্তির নাম TU QUOQUE- তুইও তো

উদাহরণ দিয়ে বোঝালেই পরিষ্কার হয়ে যাবে।

উদাহরণ ৩.৪: মনে করো, একজন তার বড় এক ভাইকে বলল, 'ভাই, একটু আগে যে আপনি বয়স্ক মানুষটার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলেন, কাজটা করা কি আপনার ঠিক হলো?' শুনে বড় ভাই 'তাই নাকি?' মজা পায় হাসিব। 'বেশ শোনাও তাহলে-' হাফিজ একটু লজ্জা পাওয়ার ভাব নিয়ে বলে,

বললে কথা লোকে, সেই কথায় নজর দাও। কথা রেখে কেন শুধুই লোকটারে খোঁচাও?

ক্লাসের সবাই হাসে। ইঙ্গিতে হাফিজকে বসতে বলে হাসিব, 'বাহ। হ্যাঁ, অনেকটা অমনই।'

সতর্কতা

তবে একটা ব্যাপারে তোমাদের সতর্ক করে দিতে চাই। ব্যক্তি আক্রমণ যে করা যাবে না, এটাই কিন্তু সব সময় সত্যি নয়। যদি আক্রমণটা প্রাসঙ্গিক হয় তখন সেটা যুক্তিযুক্ত হতেও পারে। মনে করো, একটা এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে একজন চেয়ারম্যান ছিলেন, তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকবার অভিযোগ এসেছে, তিনি গম চুরি করেন।

এখন মনে করো, ওই এলাকায় একটা দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন করা হবে, যেখানে সৎ প্রার্থী খোঁজা হচ্ছে। এবার সেই কলঙ্কিত চেয়ারম্যান ওখানে প্রার্থী হতে চাইলেন। তখন আর একজন তাকে উদ্দেশ করে বললেন, 'আপনার তো গম চুরির রেকর্ড আছে, আপনি কী করে এই পদে দাঁড়াবেন?'

এমন ক্ষেত্রে এটা কিন্তু যুক্তিযুক্ত আক্রমণ হবে। এটা ফ্যালাসি নয়।

এবার চলো, আরেকটা ভ্রান্তির কথা বলি। এটাও হরহামেশা শোনা যায়। এই ফ্যালাসির নাম হলো Tu Quoque, বা বাংলায় বললে তুমিও তো!

ভ্রান্তির নাম TU QUOQUE- তুইও তো

উদাহরণ দিয়ে বোঝালেই পরিষ্কার হয়ে যাবে।

উদাহরণ ৩.৪: মনে করো, একজন তার বড় এক ভাইকে বলল, 'ভাই, একটু আগে যে আপনি বয়স্ক মানুষটার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলেন, কাজটা করা কি আপনার ঠিক হলো?' শুনে বড় ভাই

'তাই নাকি?' মজা পায় হাসিব। 'বেশ শোনাও তাহলে-' হাফিজ একটু লজ্জা পাওয়ার ভাব নিয়ে বলে,

বললে কথা লোকে, সেই কথায় নজর দাও। কথা রেখে কেন শুধুই লোকটারে খোঁচাও?

ক্লাসের সবাই হাসে। ইঙ্গিতে হাফিজকে বসতে বলে হাসিব, 'বাহ। হ্যাঁ, অনেকটা অমনই।'

সতর্কতা

তবে একটা ব্যাপারে তোমাদের সতর্ক করে দিতে চাই। ব্যক্তি আক্রমণ যে করা যাবে না, এটাই কিন্তু সব সময় সত্যি নয়। যদি আক্রমণটা প্রাসঙ্গিক হয় তখন সেটা যুক্তিযুক্ত হতেও পারে। মনে করো, একটা এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে একজন চেয়ারম্যান ছিলেন, তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকবার অভিযোগ এসেছে, তিনি গম চুরি করেন।

এখন মনে করো, ওই এলাকায় একটা দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন করা হবে, যেখানে সৎ প্রার্থী খোঁজা হচ্ছে। এবার সেই কলঙ্কিত চেয়ারম্যান ওখানে প্রার্থী হতে চাইলেন। তখন আর একজন তাকে উদ্দেশ করে বললেন, 'আপনার তো গম চুরির রেকর্ড আছে, আপনি কী করে এই পদে দাঁড়াবেন?'

এমন ক্ষেত্রে এটা কিন্তু যুক্তিযুক্ত আক্রমণ হবে। এটা ফ্যালাসি নয়।

এবার চলো, আরেকটা ভ্রান্তির কথা বলি। এটাও হরহামেশা শোনা যায়। এই ফ্যালাসির নাম হলো Tu Quoque, বা বাংলায় বললে তুমিও তো!

ভ্রান্তির নাম TU QUOQUE- তুইও তো

উদাহরণ দিয়ে বোঝালেই পরিষ্কার হয়ে যাবে।

উদাহরণ ৩.৪: মনে করো, একজন তার বড় এক ভাইকে বলল, 'ভাই, একটু আগে যে আপনি বয়স্ক মানুষটার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলেন, কাজটা করা কি আপনার ঠিক হলো?' শুনে বড় ভাই বললেন, 'তুই যে পরশুদিন তোর চাচার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলি ওইটা ঠিক ছিল?'

এই ধরনের কথা কিন্তু প্রায়ই শোনা যায়। তবে এখানে কিন্তু একটা যুক্তির ভ্রান্তি আছে। খেয়াল করে দেখো, এখানে মূল যে প্রসঙ্গটা ছিল, বড় ভাইকে যে বলা হলো যে সে ঠিক করেছে কি না. সেই প্রসঙ্গটা কিন্তু ঘুরে গেল। সেই প্রসঙ্গের যৌক্তিকতা কিন্তু হারিয়ে গেছে।

বড় ভাইকে যখন বলা হলো যে আপনি যে অমুকের সঙ্গে জিনিসটা করলেন, কাজটা কি ঠিক হলো? সে তখন হয়তো বলতে পারত, আসলেই আমি এইটা ভুল করে ফেলেছি। অথবা সে বলতে পারত, না. ওই লোক কয়দিন ধরে খুব জ্বালাচ্ছিল কিংবা ওই বয়স্ক লোকটাই হয়তো একটা অযৌক্তিক বা অনৈতিক কাজ করছিল, তার কারণেই আমি তাকে রুখে দাঁড়িয়েছি। এগুলো হতো প্রাসঙ্গিক কথা। কিন্তু সে প্রসঙ্গটাকে প্রশ্নকারীর দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে।

ছোট ভাই ঠিক করল কি করল না, সেটা অন্য প্রসঙ্গ। তার ঠিক- বেঠিকে বড় ভাইয়ের ঠিক-বেঠিক কিছু আসে-যায় না।

উদাহরণ ৩.৫: এই ফ্যালাসিটাকে আরেকটু ভালো করে বোঝা যাবে একটা মজার উদাহরণ দিলে। মনে করো, আদালতে বিচারকের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন অপরাধী। তাকে জেরা করা হচ্ছে। অপরাধী একপর্যায়ে বলল, 'উকিল সাহেব, আপনিও তো ছোটবেলায় ছোট ছোট চুরি করেছেন, আর আমি করলেই দোষ?'

খেয়াল করো, এটা বললে কিন্তু অপরাধী কখনোই অপরাধ থেকে মুক্তি পাবে না। অর্থাৎ অন্যে কী দোষ করল সেই দোষ ধরিয়ে দিলে তার নিজের দোষ কিন্তু মাফ হয়ে যায় না। এখানে মূল প্রসঙ্গ হচ্ছে তার অপরাধ।

আরও কয়েকটা উদাহরণ চিন্তা করো।

উদাহরণ ৩.৬: মনে করো, মা তার বাচ্চাকে ডেকে বলল, বাবা, তোর ঘরটা কিন্তু খুব অগোছালো হয়ে আছে, একটু গুছিয়ে রাখ। ছেলেটা তখন বলল, 'মা. তোমার ঘরও তো খুবই অগোছালো, তাহলে আমি তোমার কথা কেন শুনব?'

মায়ের ঘর অগোছালো থাকলেই তার নিজের ঘর অগোছালো থাকাটা যুক্তিযুক্ত হয়ে যায় না।

উদাহরণ ৩.৭: এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে বলছে যে দেখ দোস্ত, আমার মনে হয় সিগারেট খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। তখন অন্যজন বলল, 'তুই নিজেই তো বিড়িখোর, এখন সিগারেটের বিরুদ্ধে কেন কথা বলিস।'

কথা আর কাজের অমিল থাকলে সেটাকে হিপোক্রেসি বলা যায়, সেই অর্থে প্রথম বন্ধু হয়তো হিপোক্রেসি-দোষে দুষ্ট। কিন্তু যুক্তির বিবেচনায় দ্বিতীয় বন্ধু যেটা করেছে, সেটা ভুল। কারণ, সে মূল যে বিষয় ছিল 'সিগারেট খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর', সেই বিষয়টা নিয়ে কথা না বলে আক্রমণ করেছে বন্ধুটিকে।

যেহেতু এই ফ্যালাসিতে প্রায়ই অন্যের হিপোক্রিসিকে ধরিয়ে দিয়ে তার বক্তব্যকে অসার প্রমাণ করার চেষ্টা করে। এ জন্য এই ফ্যালাসিকে 'Appeal to hipocrisy'ও বলা হয়।

এমন আরও একটা উদাহরণ বলি।

উদাহরণ ৩.৮: মনে করো, একজন সেলিব্রেটি। তিনি মানুষকে সচেতন

করতে চান বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বা গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের ব্যাপারে। তিনি তার এক বক্তৃতায় বলেন, আমাদের সবাইকেই সচেতন হওয়া উচিত গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়ে। এবার একজন মন্তব্য করল, 'আপনি নিজেই তো বিরাট বড় গাড়ি চালান, আপনি নিজেই তো বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য দায়ী।

খেয়াল করো, এখানে মূল বক্তব্য ছিল উষ্ণায়ন, এটা পৃথিবীর জন্য ক্ষতিকর। সেই কথা নিয়ে কিন্তু কোনো আলোচনা হলো না। এখানে আক্রমণের শিকার হলো প্রথম ব্যক্তি, সেই সেলিব্রেটি। আর মূল প্রসঙ্গ থেকে আলোচনা দূরে সরে গেল।

আর আগে যেমন বলেছিলাম যে একজনের কথা ও কাজে যদি মিল না থাকে, সেটাকে আমরা বলি হিপোক্রেসি। এখানেও হয়তো সেই সেলিব্রেটি হিপোক্রেসি দোষে দুষ্ট কিন্তু তিনি হিপোক্রেট হলেও তার বক্তব্য কিন্তু অযৌক্তিক হয়ে যায় না। যখন আমরা যুক্তির কথা বলি, তখন এই ব্যাপারটা খেয়াল রাখাটা জরুরি।

ক্লাসের পেছনে আবারও হাসির শব্দ। হাসিব জিজ্ঞেস করে, 'কী. হাফিজ কি আবারও ছড়াটড়া লিখেছ নাকি? লিখলে শোনাও।'

হাফিজ দাঁড়িয়ে বলে,

'তুইও এমন'- এইটা কইলে বুইঝ্যে শুইন্যে কোস অন্যের দোষ ধরলে পরেই কাটে না নিজের দোষ

হ্যাঁ। একদম ঠিক কথা!

এবার আমরা আরেকটা ফ্যালাসি সম্পর্কে জানব। আগের দুটোতে আমরা দেখেছি কী করে মূল প্রসঙ্গ ছেড়ে অন্য কোনো মানুষকে আক্রমণ করা হয়েছে। এবার দেখব প্রসঙ্গ ছেড়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে যাওয়ার ভ্রান্তি।

ভ্রান্তির নাম RED HERRING- প্রসঙ্গ ঘোরানো

এটা হচ্ছে কথা ঘোরানোর খেলা। এটা যে রকম বিভ্রান্তির মধ্যে ব্যবহৃত হতে পারে, তেমনি এটা সাহিত্যেও ব্যবহৃত হতে পারে। মনে করো, রোমাঞ্চকর একটা থ্রিলার পড়ছ। এমনসব থ্রিলারে প্রায়ই দেখবে, সাহিত্যিক চেষ্টা করেন মূল যে অপরাধী তাকে একটু লুকিয়ে রাখতে। অন্য একজনকে তিনি অপরাধী হিসেবে মনে করাতে চান। এরপর পাঠক শেষে গিয়ে টের পায় আসল অপরাধীটা কে। এই যে সব সময় লেখক চেষ্টা করছেন যে মূল অপরাধী তার থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে, তিনি আসলে রেড হেরিং ব্যবহার করছেন। এই নামটা কোথেকে এল, সেটা আমি পরবর্তী সময়ে বোঝাব, তবে এখন কীভাবে কুযুক্তিতে ব্যবহৃত হয়, সেটা তোমাদের একটু শেখানো যাক।

একটা উদাহরণ চিন্তা করো।

Fallacy: Red Herring

ভ্রান্তির নাম: প্রসঙ্গ ঘোরানো

পল্টু: দোস্ত, অঙ্ক পারিনি বলে স্যার বকা দিল। মনটা খুব খারাপ!

ভুল্টু: এটা কোনো মন খারাপের বিষয় হলো? পৃথিবীতে কত লোকে না খেয়ে আছে...

না ভুল্টু, তুমি ভুল করছ। পল্টুর মূল প্রসঙ্গ এখানে অঙ্ক না পারা এবং তার জন্য শিক্ষকের বকা খাওয়া। তুমি অন্য প্রসঙ্গে চলে যাচ্ছ...

উদাহরণ ৩.৯: মনে করো, একটা বাচ্চা মেয়ে তার মায়ের সঙ্গে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে সে দোকানের দিকে তাকিয়ে দেখল যে একটা খুব সুন্দর খেলনা। এটা দেখে সে তার মাকে বলল, মা. আমাকে খেলনা কিনে দাও না। সেটা শুনে তার মা বলল, তাড়াতাড়ি বাসায় চলো, আমি মজার মজার খাবার রান্না করেছি।

এখানে খেয়াল করো, মা যে কাজটা করল, সেটা হলো কথাটা ঘুরিয়ে দিল। এটা একটা রেড হেরিংয়ের উদাহরণ।

আরেকটা উদাহরণ চিন্তা করা যাক।

উদাহরণ ৩.১০: মনে করো, টোনাটুনির সংসারে বউটা তার স্বামীকে বলছে, তোমার না কথা ছিল এই কাজটা করে ফেলার। কী করলে তুমি?

স্বামী তখন বলল, দেখো, তোমার জন্য আমি একটা দারুণ ছবি আঁকছি। সুন্দর না?

খেয়াল করো, যেই কাজটার কথা বউ জানতে চাইছে, সেটার কোনো হদিস কিন্তু পাওয়া গেল না। মাঝখান থেকে অন্য একটা প্রসঙ্গ টেনে স্বামী ব্যাপারটাকে এড়িয়ে গেল।

আবার একটা উদাহরণ ভাবো।

উদাহরণ ৩.১১: ধরো, একটা মেয়ে এসে বলল যে মা, আজকে আমার

মনটা খুব খারাপ, আমার স্কুলের স্যার আমাকে বকা দিয়েছেন। মা বলল, দেখ, মন খারাপ করার আরও অনেক বিষয় আছে। পৃথিবীতে প্রতিদিন না খেয়ে এত মানুষ মারা যাচ্ছে, এ বিষয়গুলো নিয়ে তুই মন খারাপ করতে পারিস।

দেখো, এখানে মূল প্রসঙ্গটা কী ছিল? প্রসঙ্গ ছিল যে সে একটা পড়া পারেনি, সে জন্য স্যার বকা দিয়েছেন। মা এখানে বলতে পারে যে তুই ঠিকমতো লেখাপড়া কর, তাহলে আর বকবেন না। কিংবা বলতে পারে কোনো অসুবিধা নেই, আমিও একসময় বকা খেয়েছি। তুই চেষ্টা করলে তুইও পারবি। এভাবে অনেকভাবেই বাচ্চাটাকে বোঝাতে পারো। তার মানে এই না যে কতজন মানুষ পৃথিবীতে ক্ষুধার্ত আছে, তাদের কথা চিন্তা করে পড়ালেখার কথা ভুলে যেতে হবে।

এই মূল বক্তব্যটাকে পুরোপুরি অন্য খাতে প্রবাহিত করে ফেলা হলো, এটাই হচ্ছে Red Herring। প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দেওয়া। খাঁটি বাংলায় বললে এটাকে 'ত্যানা প্যাঁচানি' বলতে পারো।

আরও একটা উদাহরণ বলি।

উদাহরণ ৩.১২: মনে করো, একটা জায়গায় ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলন করছে। নিরাপদ সড়ক চাই। এবার অন্য একজন বলল, 'এখন তারা সড়ক নিয়ে আন্দোলন করছে কিন্তু যখন স্কুলে দুর্নীতি হয়েছিল, সেই দুর্নীতি নিয়ে তারা কেন আন্দোলন করল না?'

এখানেও কিন্তু রেড হেরিং। প্রসঙ্গ নিরাপদ সড়ক। সেখান থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এ ধরনের ক্ষেত্রগুলোতে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। এর কারণ হলো, তারা একরকমের মিল খুঁজে পায়। দুটোই তো পড়াশোনাসংক্রান্ত, তাহলে মনে হয় যুক্তিটা প্রাসঙ্গিক। কিন্তু আদতে দুটো আলাদা বিষয়। একটার ওপর আরেকটার কোনো নির্ভরশীলতা নেই।

'তখন উনি কই ছিলেন বা তখন তারা কই ছিল', এই ধরনের কথা যখন শুনবে, তখনই খেয়াল করবে, আদতেই দুটোর মধ্যে স্পষ্ট সম্পর্ক আছে কি না।

উদাহরণ ৩.১৩: ধরো, কেউ একজন অনলাইনে ইংরেজি পড়ায়, সেখানে কেউ মন্তব্য করল, খালি ইংরেজি পড়ালে হবে, গণতন্ত্রের কথা ভাবতে হবে না! এটাও রেড হেরিং। এখানে ইঙ্গিতটা এমন যে সে ইংরেজি পড়ালে গণতন্ত্রের জন্য সময় ব্যয় করা যায় না। আদতে এই দুটো ঘটনার মধ্যে এমন কোনো নির্ভরশীলতা নেই।

তোমরা হয়তো খেয়াল করবে রাজনীতিবিদেরা প্রায়ই রেড হেরিং ব্যবহার করেন তাদের বক্তব্যে।

উদাহরণ ৩.১৪: ধরো, একজন সাংবাদিক একজন রাজনীতিবিদকে প্রশ্ন করলেন, 'আপনার অফিসে যে দুর্নীতির খবর পাওয়া গেল, সে ব্যাপারে আপনি কিছু বলবেন?' রাজনীতিবিদ উত্তর দিলেন, 'আমি সব সময় সাধারণ মানুষকে নিশ্চিত করতে চাই যে আমি যা করি মানুষের ভালোর জন্য করি। আমি সব সময় মানুষের ভালোটার কথা সবার আগে চিন্তা করি। আমরা কয়দিন আগে যে নতুন একটা বিল পাস করলাম, সেটা গণমানুষের কথা ভেবেই পাস করেছি।'

খেয়াল করো, মূল যে প্রশ্নটা ছিল সেই দুর্নীতির প্রসঙ্গটা কিন্তু রাজনীতিবিদের বক্তব্যে গায়েব হয়ে গেছে।

হাসিব টানা ফ্যালাসিগুলো বলে থামল। এবার এনাম জিজ্ঞেস করে, 'স্যার, এটার নাম Red Herring কেন হলো?'

'হেরিং আসলে একরকমের মাছ। আমাদের ইলিশ মাছও এক জাতের হেরিং। যদিও Red Herring শুনলে মনে হয় লাল রঙের হেরিং মাছ, আসলে হেরিং কখনো লাল হয় না। হেরিং মাছকে ধোঁয়া দিয়ে ভাপ দিয়ে রান্না করলে এর ভেতরটা লাল হয়ে যায়। তখন আমাদের শুঁটকি মাছে যেমন গন্ধ থাকে, অমন একটা গন্ধ হয় মাছটাতে।

এবার এই গন্ধ মাছটা ব্যবহার করা হয় শিকারি কুকুরকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য। এটার মূল কাজ গন্ধ দিয়ে কুকুরটাকে বিভ্রান্ত করে দেওয়া। মনে করো, কুকুরটাকে শিয়াল ধরার প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। শিয়ালের গন্ধ প্রথমে চেনানো হয়। তারপর যে পথে শিয়াল গেছে ওই পথে লাল হেরিং ফেলে রাখা হয়। হেরিংয়ের গন্ধটা অনেক তীব্র হওয়ায় কুকুরটা প্রথম প্রথম বিভ্রান্ত হয়ে যায়। পরে একসময় প্রশিক্ষণ নিতে নিতে সে আলাদা করে বুঝতে পারে শিয়ালের গন্ধটা।

এই যে অন্য গন্ধ দিয়ে বিভ্রান্ত করে দেওয়া, সেখান থেকেই এসেছে প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটা।

সবাই মাথা নাড়ে।

হাসিব বলে, বেশ!

তারপর হাফিজের দিকে তাকিয়ে বলে, 'কী কবি, রেড হেরিং নিয়ে দুই লাইন হবে নাকি?'

হাফিজ দাঁড়িয়ে মাথা চুলকায়, তারপর হেসে বলে,

কী বললাম আমি, আর সে গেল কোনখানে! বুঝদার লোক ঠিকই বোঝে কথা ঘোরানোর মানে

বাহ। তুমি কি দাঁড়িয়েই বানিয়ে ফেললে? হাফিজ লজ্জা পায়।

ক্লাস সেদিনের মতো ওই পর্যন্তই রইল। হাসিব জানিয়ে গেল, পরের ক্লাসে আরও কয়েকটা ফ্যালাসি নিয়ে কথা বলা যাবে। বেরিয়ে যাওয়ার সময় পেছন থেকে কেউ একজন বলল, 'স্যার, এই যে অঙ্কের ক্লাসে অঙ্ক বাদ দিয়ে যুক্তিবিদ্যা শেখাচ্ছেন, এটাও কি রেড হেরিং?'

হাসিব ভ্রু কুঁচকে কিছু একটা ভাবল। তারপর টিচার্স রুমের দিকে হাঁটা দিল।


✪ বক্তব্যকে কি নিজের সুবিধামতো ব্যাখ্যা করছো?

আগের দিনের মতোই হাসিব ক্লাসে ঢুকল কয়েকটা কাগজের নোট নিয়ে। সেখান থেকে একটা নোটের দিকে তাকিয়ে হাসিব বলল, আজকে তোমাদের এমন একটা বিষয় নিয়ে কথা বলব, যেটা আমাদের চারপাশে আমরা প্রায়ই দেখতে পাই। আমরা প্রায়ই যুক্তি দিতে গিয়ে অন্য প্রসঙ্গের অবতারণা করে ফেলি। সেখান থেকেই এই ধরনের ফ্যালাসি বা বিভ্রান্তিগুলো তৈরি হয়। আজকে কয়েক রকমের ফ্যালাসি তোমাদের শেখাব।

এগুলোর ভেতরে একটা মিল আছে। বিষয়বস্তুকে নিজের মতো ব্যাখ্যা করে নেওয়া হয় সবগুলোতে। চলো প্রথমটাতে যাওয়া যাক- এটার নাম- Straw man fallacy বা কাকতাড়ুয়া বিভ্রান্তি।

ভ্রান্তির নাম STRAW MAN FALLACY- কাকতাড়ুয়া ভ্রান্তি

হাসিব বলল, এই ভ্রান্তিটা খুব মজার। এখানে যা হয় তা হলো, অন্য কারও কথাকে নিজের মতো করে ঘুরিয়ে-সাজিয়ে অথবা বিকৃত করে বলা হয় যেন আক্রমণ করা সহজ হয়। একটা উদাহরণ দিলে বুঝতে পারবে।

উদাহরণ ৪.১: মনে করো, ময়না আর খবিস দুই বন্ধু। ওদের বাসা পাশাপাশি। দুজন একসঙ্গে স্কুলে আসে। একদিন খবিস গিয়ে ময়নাকে ডাকল, 'কিরে ময়না, তুই স্কুলে যাবি না?' ময়না বাইরে এসে দুর্বল গলায় বলল, 'দোস্ত, আমার দুই দিন ধরে জ্বর, মাথাব্যথা। এখন যদিও জ্বর নেই, শরীরটা খুব দুর্বল। এই অবস্থায় স্কুলের কথা ভাবতেই পারছি না।'

'আচ্ছা', বলে খবিস চলে গেল। স্কুলে ময়নাকে না দেখে স্যার খবিসকে জিজ্ঞেস করলেন, 'কিরে, তোর দোস্ত আজকে আসেনি কেন?'

'স্যার, ও আসেনি, কারণ ওর নাকি স্কুলের কথা ভাবতেই ইচ্ছা করে না।'

খেয়াল করো, ময়নার না আসার যে মূল কারণ, ও যে অসুস্থ, সেটা কিন্তু খবিস বেমালুম চেপে গেল। এখন যে অবস্থা দাঁড়াল, সেটা শুনলে শিক্ষক খেপে যেতেই পারেন।

এখানে খবিস যে কথাটা বলেছে, সেখানে একটা ভ্রান্তি হয়েছে, ওর বক্তব্যটাকে বলা যায় এমন করে,

ময়নার স্কুলের কথা ভাবতে ইচ্ছা করে না (আশ্রয় বাক্য) তাই সে স্কুলে আসে নাই [সিদ্ধান্ত]

এখানে আশ্রয় বাক্যটা কিন্তু বিকৃত। ময়না বলেনি যে তার স্কুলের কথা ভাবতে ইচ্ছা করে না।

ক্লাসে ফার্স্টবয় এনাম জিজ্ঞেস করল, 'এটাকে Strawman কেন বলল?'

'এটাকে এভাবে ভাবতে পারো। মানুষ নিয়ে কথা বলার কথা, তুমি বললে কাকতাড়ুয়া নিয়ে। অর্থাৎ মানুষের একটা বিকৃত রূপকে তুমি আক্রমণ করলে। চলো আরও কয়েকটা উদাহরণ দেখা যাক!

----------------------------------
Straw Man Fallacy- কাকতাড়ুয়া ভ্রান্তি

পল্টু: দোস্ত, চল আমাদের যে কয়টা টাকা বাচে, তার কিছু গরিব মানুষকে দিই। ওদের উপকার হবে।

ভুলটু: হ্যাঁ, সব টাকা গরিবদেরই দিয়ে দে, নিজের যখন লাগবে কানাকড়িও থাকবে না!

যুক্তি
না ভুল্টু, তুমি পল্টুর কথাকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে তারপর যুক্তি দিচ্ছ, এটা ভুল। পল্টু 'সব' টাকা দিয়ে দিতে বলেনি।
----------------------------------

উদাহরণ ৪.২: শহরের ভেতরে মুদির দোকান। জরাজীর্ণ অবস্থা। ব্যবসা ভালো চলছে না। দোকানির ছেলে বাবাকে বলল, 'বাবা, আমার মনে হচ্ছে আমরা যদি লাভের কিছু টাকা দিয়ে দোকানটা একটু ঠিকঠাক করি, একটু প্রচারণা করি- ব্যবসা একটু ভালো হতে পারে।' এটা শুনে বাবা বললেন, 'হ্যাঁ, যা লাভ হয় সব আমি দোকান রং করতেই ঢেলে দিই, তাহলে আর খেয়েপরে বাঁচতে হবে না।'

খেয়াল করো, এখানে বাবাটা কিন্তু Strawmanning করলেন। সব টাকা সংস্কারে দিলে তার সমস্যা হবে এটা ঠিক কথা। কিন্তু সব টাকা দিয়ে দিতে হবে, এমন কথা কিন্তু ছেলেটা বলেনি। বাবা এমনভাবে ঘুরিয়ে নিলেন যেন আক্রমণ করতে সুবিধা হয়।

কখনো কখনো নিজের মনগত একটা মানে দাঁড় করিয়ে সেটাকেও আক্রমণ করা হয়। সেটাও কাকতাড়ুয়া ভ্রান্তিতে পড়ে।

উদাহরণ ৪.৩: ধরো, কেউ একজন বলল, আমার মনে হয় আমরা পুলিশ-মিলিটারিতে যে খরচ করি, আরেকটু কম করলেও মনে হয় হতো। দ্বিতীয়জন বলল, 'হ্যাঁ, তুমি চাও আমাদের দেশে প্রতিরক্ষা বলে কিছু না থাকুক, বাইরের দেশ এসে দখল করে নিয়ে যাক।'

এটাও স্ট্রম্যান। প্রথমজন অবাক হয়ে যাবে, 'এটা আমি কখন বললাম যে প্রতিরক্ষা বলে কিছুই না থাকুক!'

আবার মনে করো, কোনো মানুষ কথা বলতে বলতে ছোট একটা জায়গায় বেফাঁস কথা বলেছে। তার যুক্তিগুলো খুব ভালোই ছিল। সুন্দর সুন্দর যুক্তি দিয়ে সে কথা বলছিল। কিন্তু একটা জায়গায় বেফাঁস কথা বলেছে। তুমি এখন তার মূল বিষয়গুলো বাদ দিয়ে ওই যে একটা বেফাঁস কথা বলে ফেলেছে, সেটাকে ধরে আক্রমণ করলে।
তারপর বললে, যে এই ধরনের কথা বলতে পারে তার কোনো কথাই ঠিক না। এমন বলাটাও কিন্তু স্ট্রম্যান যুক্তির ভেতরে পড়বে।

হাসিব এটুকু বলে ক্লাসের পেছনে তাকায়। হাফিজের দিকে চোখ পড়তেই সে উঠে দাঁড়ায় না বলতেই। বলে,

তাই বলে তুমি এমন করো তর্কে জেতার জন্য 
এমন করেই বদলাও কথা মানে হয়ে যায় অন্য

হাসিব হাসে। হ্যাঁ, এমন করে বিকৃত করা যাবে না, যেন প্রতিপক্ষের মূল বক্তব্যের একটা অন্য মানে দাঁড়া হয়ে যায়। এবার এমন বিকৃত করার আরেকটা কুযুক্তি নিয়ে বলা যাক, সেটাকে বলে False Dichotomy। 

-----------------------------------------
ভ্রান্তির নাম FALSE DICHOTOMY FALLACY- ভ্রান্ত দ্বি-বিভাজন

এই ধরনের ক্ষেত্রে যেটা হয় তা হলো, মানুষ সব রকমের অপশন বিবেচনা করে না। একটা না হলেই আরেকটা হবে এমন কিছু একটা ধরে নিয়ে যুক্তি দেয়। যেমন কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।

Fallacy: False Dichotomy 
ভ্রান্তি: ভ্রান্ত দ্বি-বিভাজন

পল্টু: ভারতের খেলা সেদিন আমার বেশি ভালো লাগে নাই।

ভুল্টু: তুই নিশ্চয়ই পাকিস্তানের সাপোটার...

যুক্তি
না ভুল্টু। ভারতকে সমর্থন না করলেই সে পাকিস্তানের সমর্থক হবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। পল্টু শুধু বাংলাদেশেরও সাপোর্টার হতে পারে।
-----------------------------------------

উদাহরণ ৪.৪: মনে করো, ফুটবল বিশ্বকাপ চলছে। বাসের ভেতরে

একজন যাত্রী আর্জেন্টিনার খুব গুণকীর্তন করছিল। শুনে পাশের একজন বলল, 'ভাই, এখনো আর্জেন্টিনাকে কীভাবে সাপোর্ট করেন? ওরা তো বিশ্বকাপ জিততেই পারে না।' শুনে প্রথমজন বললেন, 'আর্জেন্টিনা কী, এটা আপনারা ব্রাজিলের সাপোর্টাররা জিন্দেগিতে ও বুঝবেন না।'

এখানে একটা ভুল হয়েছে। কেউ কি বলতে পারবে ভুলটা কী?

মিলা বলল, 'স্যার, পাশেরজন যে ব্রাজিলেরই সাপোর্টার, এটা সে কীভাবে বলল?'

ঠিক তাই! একজন আর্জেন্টিনাকে সমর্থন না করলেই সে ব্রাজিলের সাপোর্টার, এটা কোনোভাবেই নিশ্চিত হওয়া যায় না। জার্মানি, ইতালি, ইংল্যান্ড আরও কত দল আছে, তাই না?

Dichotomy মানে হলো দুই ভাগে বিভক্ত। False Dichotomy মানে হলো আসলে দুই ভাগে বিভক্ত না, আরও অপশন আছে, কিন্তু মানুষ অনুমান করে নিচ্ছে যে দুই ভাগেই বিভক্ত। তারপর সেটা ভেবে নিয়ে আক্রমণ করছে।

উদাহরণ ৪.৫: তুই যদি আমার দলকে সমর্থন না করিস, তাহলে তুই আসলে অন্য দলটাকে সমর্থন করিস।

বলো দেখি, ভুলটা কোথায়?

এনাম বলল, 'স্যার, এমনও তো হতে পারে, সে তৃতীয় আরেকটা দলকে সমর্থন করে।' সুজন বলল, 'আবার ধরেন, এমনও যদি হয় যে সেখানে দুইটাই মাত্র দল আছে, তখনো এই যুক্তি ঠিক না হতে পারে। এমন হতেই পারে যে, সে দুইটা দলের কোনোটাকেই সমর্থন করে না. দুইটার ওপরেই বিরক্ত।'

হাসিব মুগ্ধ হয়, 'চমৎকার। একেবারে ঠিক বলেছ তোমরা। তার মানে এই দুইটাই শুধু অপশন, ব্যাপারটা এমন নয়।'

এবার হাসিব বলে,

আগের উদাহরণটার সূত্র ধরে মনে পড়ল একটা প্রচলিত উক্তি, যেটা যুক্তির বিবেচনায় ভুল। সেটা হলো, 'শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু।'

উঁহু, এটা কিন্তু নিশ্চিত হওয়া যায় না। এমন হতেই পারে যে শত্রুর যে শত্রু, সে অন্য দুজনকেই ঘৃণা করে।

উদাহরণ ৪.৬: উদাহরণস্বরূপ বলা যায় হিটলারের কথা। আমি কিছু

মুসলিমদের চিনি যারা মনে করে, ইহুদিরা তাদের শত্রু। তাদের ভেতরে কয়েকজনকে চিনি যারা মনে করে, যেহেতু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার ইহুদিদের মেরেছে, তাই হিটলার মুসলিমদের বন্ধু। অথচ হিটলারের লেখা থেকে জানা যায়, সে মুসলিমদের নিচু জাতের মনে করত। অর্থাৎ যুক্তিটা খাটছে না।

যা হোক, 'শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু' এমন অনেক উক্তি আসলে যুক্তির বিবেচনায় ধোপে টেকে না। আরেকটা এমন প্রচলিত উক্তির কথা বলি।

উদাহরণ ৪.৭: লেখাপড়া করে যে গাড়িঘোড়া চড়ে সে। তাই লেখাপড়া করা উচিত।

এটার ভেতরও একটা প্রচ্ছন্ন ডাইকোটমি আছে। এখানে লেখাপড়া করার যে প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে, সেটা হলো গাড়িঘোড়া চড়া বা আরেকটু সহজ করে বললে বিত্ত অর্জন। এখন কেউ যদি সেটাতে আগ্রহী না হয়?

আরেকটা উদাহরণ বলি।

অনেক সময় Dichotomy-টা লুকানো থাকে।

উদাহরণ ৪.৮: একসময় আকাশে ফ্লাইং সসার দেখা যাচ্ছে- এ নিয়ে মাতামাতি হয়েছিল বেশ। তখন অনেক মানুষের বক্তব্য ছিল এমন, বিজ্ঞানীরা পারলে ব্যাখ্যা করুক এই উড়ন্ত জিনিসগুলো কোথেকে এসেছে। ব্যাখ্যা না করতে পারলে মেনে নিক যে এটা এলিয়েনদের কাজ।

এখানেও মাত্র দুই রকমের অপশন নিয়ে চিন্তা করা হচ্ছে। এক প্রকারের জিনিস হলো পৃথিবীর, সেগুলো বিজ্ঞানীরা ব্যাখ্যা করতে পারে আর আরেক প্রকার হলো পৃথিবীর বাইরের, যেটা বিজ্ঞানীরা ব্যাখ্যা করতে পারে না।

কিন্তু আসল ঘটনা হলো, এমন বহু কিছু আছে, যেটার ব্যাখ্যা বিজ্ঞানীরা এখনো জানেন না। ব্যাখ্যা না করতে পারলেই সেটা পৃথিবীর বাইরের, এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। Appeal to ignorance বলে একটা ফ্যালাসি আছে, যেটা এটার সঙ্গে সম্পর্কিত। আমরা সেটার কথা পরে বলব।

এতক্ষণ তো শুধু দুই রকমের অপশন নিয়ে বললাম। কিন্তু এই ভ্রান্ত বিভাজন দুইয়ের বেশি অপশনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে। ধরো, কোথাও অনেক অপশন আছে, কিন্তু মানুষ এমনভাবে বলল যে তোমাকে তিনটের ভেতরেই একটাকে বেছে নিতে হবে, সেটাও কিন্তু False Dichotomy-রই আরেকটা রূপ।

হাসিব পেছনের সারিতে হাফিজের দিকে তাকায়, 'কী কবি, দুটো লাইন হবে নাকি?'

হাফিজ স্বভাবকবি। সে তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে বলে,

এইটা না হলে ঐটাই হবে এমন বলার আগে 
আর কী জিনিস হওয়া সম্ভব সেইটাও ভাবা লাগে

ঠিক তাই, কী কী হওয়া সম্ভব সবই চিন্তা করে তারপরে যুক্তি দিতে হয়। এবার আরেকটা যুক্তির কথা বলব, যেখানে বক্তা একটা উপমা ব্যবহার করেন, তারপর উপমাটা দিয়েই কোনো কিছুকে ব্যাখ্যা করেন। এটা খারাপ কিছু না, কিন্তু উপমাটা যুক্তিযুক্ত কি না, সেটাও খেয়াল রাখাটা দরকার।

✪ ভ্রান্তির নাম FALSE ANALOGY- ভ্রান্ত উপমা

একটা বিষয়ের উপমা আরেকটা দিয়ে দেওয়ার সময় খেয়াল রাখতে হয় যে যেটা মূল সিদ্ধান্ত, সেটার জন্য উপমাটা প্রাসঙ্গিক কি না। একটা উদাহরণ দেখি চলো।

উদাহরণ ৪.৯: ধরো, কেউ একজন এভাবে যুক্তি দিচ্ছে-

গাড়িতে চড়ার কারণে মানুষ মরে [আশ্রয় বাক্য]

সিগারেট খেলেও মানুষ মরে [আশ্রয় বাক্য]

সিগারেট খাওয়া যদি নিষিদ্ধ হয়, তাহলে গাড়ি চড়াও নিষিদ্ধ করা

উচিত [সিদ্ধান্ত]

এই উদাহরণের সমস্যা হলো- তুলনাটা অযৌক্তিক। প্রথমে শ্রোতাকে বোকা বানানোর জন্য একটা মিল দেখানো হয়েছে 'দুটোর কারণেই মানুষ মরে'। কিন্তু এই মিলটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য যথেষ্ট কি না, সেটা বিচার করা জরুরি। অনেক ব্যাপার এখানে জড়িয়ে আছে। উদাহরণস্বরূপ ভাবতে পারো, গাড়িতে চড়া বাদ দিয়ে দিলে সমাজ ও অর্থনীতিতে যে প্রভাব পড়বে, সিগারেট নিষিদ্ধ করলে প্রভাব কি একই হবে?

Fallacy: False Analogy 
ভ্রান্তি: ভ্রান্ত উপমা

পল্টু: নতুন যে নায়কটা আসছে, সে দেখতে একদম সালমান শাহর মতো...

ভুলটু: তাহলে সে নিশ্চয়ই সালমান শাহর মতো বড় নায়ক হবে।

যুক্তি: না ভুল্টু, ভুল করছো। উপমার ভুল প্রয়োগ। শুধু একদিকে মিল থাকলেই অন্য বিষয়গুলো সম্পর্কে নিশ্চিত সিদ্ধান্ত দেওয়া যায় না।


উদাহরণ ৪.১০: আবার ধরো, কেউ বলল শেয়ারবাজারে টাকা ঢালা আর লটারির টিকিট কেনা একই কথা। কারণ, পুরাটাই অনিশ্চয়তার খেলা।

এখানেও সমস্যা হলো, তুলনাটা অযৌক্তিক। লটারির টিকিট আর শেয়ারবাজার দুই জায়গাতে অনিশ্চয়তা আছে, তার মানেই দুটো এক নয়। লটারির টিকিটে নিজের বিচার-বুদ্ধি-ট্রেন্ড বিশ্লেষণ করে বুদ্ধিমান সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ খুবই কম। সেখানে প্রায় পুরোটাই ভাগ্যের ওপরে। এভাবে ভাবো, পাঁচটা টিকিট থেকে আন্দাজে একটা তুলে নিলে অন্য টিকিটগুলোর থেকে জেতার সম্ভাবনা কমে যাবে না।

সে তুলনায় শেয়ারবাজার অনেক হিসাব-নিকাশের জায়গা। পাঁচটা শেয়ারের সুযোগ আছে, সেখান থেকে কেউ আন্দাজে একটা তুলে নিলে জেতার সম্ভাবনা একই থেকে যাবে, এমন বলা যায় না।

এমন আরও কয়েকটা উল্টোপাল্টা তুলনার উদাহরণ দিতে পারি।

উদাহরণ ৪.১১: চাল আর গম তো একই রকম দানা, দুটোই শর্করা। চাল দিয়ে রান্না করা বিরিয়ানি খেতে মজা। তাহলে গম দিয়ে রান্না করা বিরিয়ানিও মজা হবে।

শুধু দানা আর দুটোই শর্করা এই মিল থেকে আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি না যে দুটোই মজা হবে।

উদাহরণ ৪.১২: নতুন এক নায়ক এসেছে, দেখতে সালমান শাহের মতো। নিশ্চয়ই সে-ও বিরাট বড় নায়ক হবে।

আগেরবারের মতোই শুধু চেহারার মিল থেকে আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি না, সে সালমান শাহের মতো বড় নায়ক হবে। সমস্যা কেউ ব্যাখ্যা করতে পারো?

সুজন হাত তুলল, 'স্যার, আমার মনে হয় যেই সিদ্ধান্তটা আমরা নিতে চাচ্ছি, সেটার জন্য কী কী বিষয় দরকারি তার সবকিছু না দেখে শুধু একটা দিকে মিল পেলেই আমরা খুশি হয়ে যাচ্ছি। যেমন ধরেন, নায়ক হতে গেলে খালি তো চেহারা থাকলেই হয় না,  অভিনয়-দক্ষতা থাকতে হয়, তার অ্যাটিচিউড ঠিক থাকতে হয়, এমনকি দক্ষতার বাইরেরও বিষয় আছে। যেমন ধরেন, পরিচালকের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক থাকতে হয় ইত্যাদি। এখন শুধু চেহারায় মিল থাকলে আমরা কী করে নিশ্চিত হব যে সে সালমান শাহের মতো বড় নায়ক হবে?'

'ঠিক তাই!' উত্তর শুনে খুশি হয় হাসিব। হাসিব ক্লাসের পেছনে হাফিজের দিকে তাকায়। এটা একটা রেওয়াজের মতো হয়ে যাচ্ছে। হাফিজ দাঁড়ায়। ওর মুখে কিছুটা বিরক্তি মনে হলো। বলে,

কিসের সঙ্গে মেলাচ্ছ কী, মেলাও ধৈর্য ধরে 
ভুল উপমায় অনেক কিছুই ঠিক লাগে ভুল করে

বাহ্, সুন্দর বলেছ। কিন্তু তুমি কি আরও কিছু বলতে চাও, হাফিজ?

'জি স্যার', হাফিজ বলে, 'আর ছড়া কাটব না, কবিদের গৎবাঁধা নিয়মে অভ্যস্ত হওয়া যাবে না।'

'আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি বসো। তোমাকে আর অনুরোধ করব না!' হাসিবেরও একটু মন খারাপ হয়। প্রসঙ্গ ঘোরাতে এবার অন্যদের দিকে তাকিয়ে বলে,

'এই False Analogy ফ্যালাসিটার মতো আরেকটা ফ্যালাসি আছে, যেখানে একই শব্দকে একবার উপমার অর্থে ব্যবহার করে আরেকবার আক্ষরিক অর্থে ব্যবহার করে যুক্তি দেওয়া হয়। সেটাকে বলে Equivocation।'

✪ ভ্রান্তির নাম EQUIVOCATION– ভিন্ন অর্থে একই শব্দ ব্যবহারের ভ্রান্তি

একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যেতে পারে।

উদাহরণ ৪.১৩: রমিজ সাহেব এখন টাকার কুমির হয়েছেন। ওনার থেকে সাবধান থেকো, কুমির যেমন সুযোগ পেলেই কামড় দেয়, উনিও সুযোগ পেলেই তোমার ক্ষতি করবেন।

এখানে ঝামেলাটা হয়েছে কুমির শব্দটা নিয়ে। এমনিতে কুমির শুনলে একটা ভয়ংকর প্রাণীর চেহারা মাথায় আসে। কিন্তু টাকার কুমির অর্থ হলো ধনী ব্যক্তি, যার অনেক টাকা আছে। সে ভয়ংকর হবেই এমন কোনো কথা নেই। তাকে আক্ষরিক অর্থে কামড়ে দেওয়া কুমিরের সঙ্গে তুলনা করা অযৌক্তিক।

Fallacy: Equivocation
ভ্রান্তি: একই শব্দের বিভ্রান্তিকর ব্যবহার

পল্টু: আমাদের ক্লাসে যে নতুন ছেলেটা এসেছে তার বাবা কিন্তু টাকার কুমির...

ভুল্টু: কুমির কিন্তু কাছে গেলেই কামড় দেয়। ওনার কাছে যাস না...

যুক্তি: না ভুল্টু, আবারও ভুল। একই শব্দকে দুই অর্থে ব্যবহার করলে এমন ভ্রান্তি হয়। টাকার কুমির মানে বড়লোক। এর সাথে আক্ষরিক অর্থে কুমির নামক প্রাণীকে তুলনা করার কিছু নাই।

উদাহরণ ৪.১৪: বাচ্চাদের কাদামাটির মন। কাদামাটি আগুনে পুড়িয়ে ইট বানাতে হয়। তাই বাচ্চাদের একটু কষ্ট দিলে খারাপ না, মন শক্ত হবে।

এখানে কাদামাটি শব্দটার যাচ্ছেতাই ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। বাচ্চাদের মন কাদামাটির বলার মানে হলো, তাদের শিখিয়ে-পড়িয়ে মনটাকে নানা আকার দেওয়া যায়। এটাকে আক্ষরিক কাদামাটি ধরে তাকে পোড়ানোর চিন্তা উপমার ভুল প্রয়োগ। একই সঙ্গে ভ্রান্ত উপমা এবং শব্দ-বিভ্রান্তির উদাহরণ এটা।

শব্দ-বিভ্রান্তির কথা বলতে গিয়ে একটা প্রবাদের কথা মাথায় এল, 'মাছের তেলে মাছ ভাজা'। অনেক সময় বক্তা আশ্রয় বাক্যটাকেই একটু ঘুরিয়ে সিদ্ধান্ত হিসেবে উপস্থাপন করে। এটাকে বলে চক্রীয় যুক্তি 'circular reasoning'। এটাকে Begging the question-ও বলে।

চলো, সেটা একটু দেখে আসি।

✪ ভ্রান্তির নাম BEGGING THE QUESTION/ CIRCULAR REASONING- চক্রাকার যুক্তি

এই ধরনের ভ্রান্তির মূল কাঠামো খুব সহজ: 'এটা সত্যি, কারণ এটা সত্যি।' একটা উদাহরণ দিয়েই ব্যাপারটা বোঝাই।

উদাহরণ ৪.১৫: মনে করো, একজন মানুষ বক্তব্য দিচ্ছে,

'আমরা সবচেয়ে ভালো যে কাজটা করতে পারি তা হলো, একে অন্যকে ভালোবাসতে পারি। কারণ, ভালোবাসার চেয়ে ভালো কিছু আর নেই।'

রিতা হেসে বলল, 'স্যার, শুনতে তো ভালোই লাগছে। সমস্যা কোথায়?'

হাসিব এনামের দিকে তাকায়। এনাম বলে, 'আমি মনে হয় বুঝতে পেরেছি। যেটাকে সে ধরে নিয়েছে, যেটা তার আশ্রয় বাক্য, সেটাই তার সিদ্ধান্ত।'

হ্যাঁ, হাসিব বলে, আসলে এখানে একই কথা দুইবার ঘুরিয়ে বলা হয়েছে। একটা আরেকটার কারণ নয়। এমন করে একটা উক্তি চিন্তা করো,

Fallacy: Begging the question
ভ্রান্তি: চক্রাকার যুক্তি

পল্টু: তুই আসলে ভালো মানুষ, কারণ তুই খারাপ না।
ভুল্টু: পল্টু, বন্ধুকে প্রশংসা করা খারাপ না। কিন্তু যুক্তির বিবেচনায় এখানে একটা ভ্রান্তি ঘটেছে। তুমি কারণ আর ফলাফলে একই কথা বলেছ।


উদাহরণ ৪.১৬: পটোলবাবু একজন সত্যবাদী মানুষ। কারণ, তিনি সব সময় সত্যি কথা বলেন।

এখানেও দেখো আসলে একই কথা দুইবার বলা হয়েছে। 

উদাহরণ ৪.১৭: কথা বলার স্বাধীনতা খুব জরুরি, কারণ মানুষকে স্বাধীনভাবে কথা বলতে দেওয়া উচিত।

আশা করছি বুঝতে পারছ এখানে সমস্যাটা কোথায়? সব সময় কিন্তু এই চক্রাকার যুক্তি এত সরল-সোজা হয় না। অনেক সময় ব্যাপারটা বেশ ঘুরিয়ে হয়। একটা চক্রের মতো। উদাহরণ দিই।

একুল একজন সত্যবাদী। কারণ, বিকুল বলেছে সে সত্যবাদী।

বিকুল যে সত্যবাদী সেটা কী করে জানো? কারণ, সিকুল বলেছে, বিকুল সত্যবাদী।

সিকুল যে সত্যবাদী সেটাই-বা কী করে জানো? কারণ, ডিকুল বলেছে, সিকুল সত্যবাদী। ডিকুল যে সত্যবাদী, সেটা কী করে জানো? কারণ, একুল বলেছে, ডিকুল সত্যবাদী।

খেয়াল করে দেখো, একটা চক্র শেষ হয়েছে এখানে। নিজেরাই নিজেদের সত্যায়ন করছে। এখান থেকে একুল সত্যবাদী কি না, তা কোনোভাবেই প্রমাণ হয় না।

খেয়াল করে দেখবে, এখন পর্যন্ত যে ফ্যালাসিগুলো নিয়ে বলেছি সব জায়গাতেই বক্তা অন্যকে যুক্তিতে হারানোর জন্য কথাকে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করছেন- কখনো ভুল উপমা দিয়ে, শব্দকে কৌশলে ব্যবহার করে। এবার আজকের শেষ যে ফ্যালাসিটা বলব সেটা হলো, হার না মেনে নেওয়ার ফ্যালাসি। এই ফ্যালাসির নাম No True Scotmans' প্রকৃত বাঙালি ভ্রান্তি।

ভ্রান্তির নাম NO TRUE SCOTMANS- প্রকৃত বাঙালি ভ্রান্তি

ধরো, কেউ একটা বিষয় নিয়ে ঢালাও একটা মন্তব্য করে বসল। তাকে ভুল ধরিয়ে দেওয়া হলো উল্টো একটা উদাহরণ দিয়ে। সে তখন নিজের ভুল স্বীকার না করে বলল, 'ওরা আমার হিসাবের মধ্যে নেই, ও বাদে বাকিদের জন্য আমার কথা সত্য।'

উদাহরণ দিলেই বুঝতে পারবে।
উদাহরণ ৪.১৮: ধরো, কেউ একজন নেতা গর্ব করে বলল, 'কোনো বাঙালি কোনো দিন চুরি করে না।' পাশ থেকে একজন বলল, 'স্যার, ওমুকচোরা তো বিখ্যাত চোর, সেও তো বাঙালি।' নেতা এবার বলল, উঁচু, সে প্রকৃত বাঙালি না। কোনো প্রকৃত বাঙালি কোনো দিন চুরি করে না।'

এই 'প্রকৃত' কথাটা বলে সে তার আগের অবস্থানকে সুবিধামতো বদলে নিল।

No True Scotmans ফ্যালাসিতে এমন ব্যাপারই বারবার দেখা যায়। নেতা যখন ঢালাওভাবে ঘোষণা দিয়েছেন, তখন একজন উল্টো উদাহরণ দিয়েছেন। ফলে তার বক্তব্য ভুল প্রমাণিত হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু তিনি তার বক্তব্যকে কায়দা করে বদলে নিলেন।

সমস্যা হলো, বাঙালি কী জিনিস সেটা ভাষা দিয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যা না করতে পারলেও মানুষের একটা ধারণা আছে। বাংলা ভাষাভাষী মানুষ বা বাংলা অঞ্চলের সংস্কৃতির ধারক-বাহক মানুষকে সাধারণভাবে মানুষ বাঙালি হিসেবে চেনে। কিন্তু 'প্রকৃত বাঙালি' কী জিনিস, এটা খুব অস্পষ্ট। এটা যে যার মতো করে ভেবে নিতে পারে। যার যা পছন্দ না, সেটাকে সে 'প্রকৃত বাঙালি'র বৈশিষ্ট্যের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে দিতে পারে।

এটার উদাহরণ রাজনীতিতেও হরহামেশা দেখা যায়।
উদাহরণ ৪.১৯: রাজনীতিবিদকে বলা হলো, 'আপনার দলের একজন আজকে সন্ত্রাসী কান্ড করেছে।' সে সঙ্গে সঙ্গে বলে দিল, 'সে আসলে আমার দলের না।' আমার দলের কেউ এমন কাজ করতে পারে না। খোঁজ নিলেই দেখবে, সে আসলে বিপক্ষ দলের সঙ্গে ছিল।'

এখানেও No True Scotmans ফ্যালাসি। আরও একটা উদাহরণ ভাবি।

Fallacy: No True Scotsman
প্রকৃত বাঙালি ভ্রান্তি

ভুল্টু: আমজনতা দলের কোনো কর্মী কখানো দুর্নীতি করে না।

পল্টু: কেন ওই দলের ফগা যে দুর্নীতির দায়ে জেল খাটলো?

ভুল্টু: ফগা আমজনতা দলের প্রকৃত কর্মী না...

যুক্তি:
না ভুল্টু, এটা ভ্রান্তিকর যুক্তি। প্রকৃত শব্দটা লাগিয়ে তুমি জোর করে বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছ। 'প্রকৃত কর্মী' কী জিনিস কেউ জানে না।

উদাহরণ ৪.২০: একটা অফিসে সৃষ্টিশীল কাজকর্ম হয়। সেখানকার নিয়োগ কর্মকর্তা কখনো প্রতিবন্ধী মানুষদের নিয়োগ দিতে চান না। তিনি বলেন, 'প্রতিবন্ধীরা কখনো সৃষ্টিশীল হতে পারে না।' তাকে বলা হলো, 'কিন্তু হেলেন কেলার তো প্রতিবন্ধী হয়েও কী দারুণকাজ করেছেন। এমন আরও অনেকেই আছেন।' তিনি বললেন, হেলেন কেলার আসলে মনের দিক থেকে প্রতিবন্ধী ছিলেন না।

এখানেও দেখো, তিনি বক্তব্যকে একটু পাল্টে নিলেন যেন নিজের কথাটা ঠিক থাকে। বন্ধুদের মধ্যে কথাবার্তাতেও এমন ফ্যালাসির প্রয়োগ দেখা যায়।

উদাহরণ ৪.২১: আসল পুরুষ কখনো কিছুতে ভয় পায় না। তুই রাতে জঙ্গল দিয়ে যেতে ভয় পাচ্ছিস। তুই আসলে পুরুষই না।

হাসিবের এই উদাহরণে হাসে সবাই। ভুলটা এখন চোখে ধরা পড়ে। পুরুষ ব্যাপারটা সবাই বুঝলেও আসল পুরুষ ব্যাপারটা কী, এটা নিয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় না। যে যার মতো করে ব্যাপারটাকে ব্যবহার করতে পারে


এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আমার আব্দুল ও’রকম নয় (লাভ জিহাদ)

সন্দেহজনক উপায়ে সনাতনী ছেলে বা মেয়েদের প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে ধর্মান্তর করা, পরবর্তীতে বিয়ে করাকে লাভ জিহাদ বলে। আমাদের কাছে যেসব তথ্য আছে তাতে আমরা জেনেছি, রীতিমতো বৈদেশিক পয়সা আসে এই জেহাদি কাজের জন্য। সম্প্রতি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রী অংকন বিশ্বাস এর অকাল মৃত্যুতে এই বিষয়টি প্রবলভাবে সামনে এসেছে। একটি মধ্যবিত্ত শিক্ষিত হিন্দু পরিবারে বেড়ে ওঠা একটি ছেলে এবং একটি মেয়ের মনোজগতের মধ্যে হাজার মাইলের তফাৎ আছে। একটি ছেলে বোধ হবার পরই সে উপলব্ধি করে সে যতটুকু মানুষ তার অধিক সে হিন্দু। উঠতে বসতে ঘরে বাইরে সর্বত্র তার চারপাশের মানুষ তাকে বুঝিয়ে দেয় সে হিন্দু এবং একজন দ্বিতীয় শ্রেণির মানুষ। ওই একই পরিবারের একটি মেয়ের জীবন হয় ঠিক উল্টো। উঠতে বসতে চারপাশের মানুষ তাকে বুঝিয়ে দেয় সে হিন্দু এবং একারণেই সে অধিক আদরণীয়। বাবা মা মেয়ের প্রতি বিশেষ নজর দেয়। এই বিশেষ নজর রাখা ২ রকমের হয়। অধিক শাসনে রাখা, বাবা-মা এর সাথে মানসিক দুরত্ব সৃষ্টি হয়। আরেক রকম হচ্ছে মেয়ে যা বলে তাতেই সায় দেয়া। মেয়ে উচ্ছন্নে গেলেও আধুনিক হিন্দু বাবা-মা তাতে তাল দেন। অন্যদিকে বাইরের দুনিয়ায় সে একেবারে রাজেন্দ্রাণির মত...

মুক্তিযুদ্ধে হিন্দুদের আত্মত্যাগ

কয়েকজন বোধহীন বুদ্ধিমান রাজনৈতিক নেতাদের অবিমৃষ্যতার কারণে ১৯৪৭ সালে ভারত ভেঙ্গে পাকিস্তান হলো। দেশ ভাগ হবার আগ-পর যেসব হিন্দু ব্যক্তিবর্গ পাকিস্তান অংশে ছিলেন তাদের বড় একটা অংশ সহায় সম্পত্তি ফেলে পশ্চিম বাংলায় চলে গেলেন। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের মতো কিছু ব্যক্তি পূর্বপুরুষের ভুমি আঁকড়ে ধরে মাতৃভূমির মানুষদের সাথে নিয়ে বাঁচতে চাইলেন। আবার অন্যদিকে যোগেন মণ্ডলের মতো নেতারা উচ্চবর্ণের হিন্দুর থেকে মুসলিমরা শ্রেয় এই মূঢ় তত্ত্বে বিশ্বাস করে জিন্নাহ’র সাথে গাট বাঁধলেন। আদতে ভারতবর্ষের হিন্দুরা কখনো একতাবদ্ধ ছিলো না- যার কারণে ইরান, তুরান, মোগল, মঙ্গোল, সাত সাগরের পার থেকে বিভিন্ন হানাদাররা এসেছে আর এদেশ শাসন করেছে। ইংরেজরা যখন এদেশ ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে তখনো সনাতনীদের কোনো একক দল গড়ে ওঠেনি, নিজেদের মধ্যে কোনো ঐক্য নেই। সেসময় মুসলিমরা মোটা দাগে সবাই মুসলিমলীগের সাথে থাকলেও হিন্দুদের তেমন কোনো গ্রহনযোগ্য দল ছিলো না। হিন্দুদের কেও বাম, কেও কংগ্রেস ইত্যাদি রাজনৈতিক দলে বিভক্ত ছিলো। ১১ আগষ্ট ১৯৪৭ তারিখে পাকিস্তান এসেম্বলিতে জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া প্রথম ভাষণে জিন্নাহ বললেন, “Now I think we should keep ...

দিব্যজ্ঞান নয় কাণ্ডজ্ঞান চাই, শিবপ্রসাদ রায়

দিব্যজ্ঞান নয় কাণ্ডজ্ঞান চাই, শিবপ্রসাদ রায় ছোটোবেলায় একটা বই পড়েছিলাম, নাম “বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা চলে না।” বড় হয়েও এদেশের বহু ঘটনার বুদ্ধি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারছি না। মনে হচ্ছে গোটা দেশের ভাবনা-চিন্তাগুলো যেন একটা অবাস্তব ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে। অবিলম্বে যদি আমরা বাস্তবের মাটিতে পা না রাখতে পারি, আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে চরম সর্বনাশ। এদেশের অর্থনৈতিক বিপর্যয় এবং মনুষ্যত্বের অবক্ষয়ের জন্য দায়ী করা হয় ভারত বিভাগকে। এই ভারত বিভাগ ছিল এদেশের তাবৎ হিন্দু নেতৃবৃন্দের নির্বুদ্ধিতার পরিণতি। শতকরা সাতানব্বই জন মুসলমানের দাবী ছিল : হিন্দু মুসলমান দুটো পৃথক জাতি। হিন্দুর সঙ্গে পাশাপাশি বাস করে মুসলমানদের ধর্ম সংস্কৃতি অক্ষুণ্ণ রাখা অসম্ভব। অতএব আমাদের একটা হোমল্যান্ড চাই, যার নাম পাকিস্তান। মুসলমান সমাজের পুরোটাই যখন ভারতবর্ষকে দুখণ্ড করতে ব্যস্ত, তখন হিন্দু নেতারা কি করছিলেন? জনগণকে বোঝাচ্ছিলেন, হিন্দু মুসলমান পৃথক জাতি নয়। এক জাতি, ভারতীয় জাতি। মুসলীম লীগ এবং মহম্মদ আলি জিন্নার দ্বিজাতিতত্ত্ব এবং পাকিস্তানের দাবী সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। মহাত্মা গান্ধী বললেন : ভারত দ্বিখণ্ডিত হলে তা আমা...

বর্তমান হিন্দু-মুসলমান সমস্যা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

১৯২৬ সালে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় একটি ভাষন দেন যার নাম “বর্তমান হিন্দু মুসলমান সমস্যা”। এটি বাঙলা প্রাদেশিক সম্মেলনে প্রদান করেন। পরে তা হিন্দু সংঘ পত্রিকায় ছাপা হয় ১৯ শে আশ্বিন ১৯৩৩ সালে। পাঠকদের বলবো মনোযোগ দিয়ে পড়ুন এবং ভাবুন।  ------- কোন একটা কথা বহু লোকে মিলিয়া বহু আস্ফালন করিয়া বলিতে থাকিলেই কেবল বলার জোরেই তাহা সত্য হইয়া উঠে না। অথচ এই সম্মিলিত প্রবল কণ্ঠস্বরের একটা শক্তি আছে এবং মোহও কম নাই। চারিদিক গমগম করিতে থাকে—এবং এই বাষ্পাচ্ছন্ন আকাশের নীচে দুই কানের মধ্যে নিরন্তর যাহা প্রবেশ করে, মানুষ অভিভূতের মত তাহাকেই সত্য বলিয়া বিশ্বাস করিয়া বসে। Propaganda বস্তুতঃ এই-ই। বিগত মহাযুদ্ধের দিনে পরস্পরের গলা কাটিয়া বেড়ানই যে মানুষের একমাত্র ধর্ম ও কর্তব্য, এই অসত্যকে সত্য বলিয়া যে দুই পক্ষের লোকেই মানিয়া লইয়াছিল, সে ত কেবল অনেক কলম এবং অনেক গলার সমবেত চীৎকারের ফলেই। যে দুই-একজন প্রতিবাদ করিতে গিয়াছিল, আসল কথা বলিবার চেষ্টা করিয়াছিল, তাহাদের লাঞ্ছনা ও নির্যাতনের অবধি ছিল না। কিন্তু আজ আর সেদিন নাই। আজ অপরিসীম বেদনা ও দুঃখ ভোগের ভিতর দিয়া মানুষের চৈতন্য হইয়াছে যে, সত্য বস্তু সেদিন...

রক্তাক্ত শারদ’ ২০২১

রক্তাক্ত শারদ’ ২০২১ (১) ২০১৬ সালে ব্রাহ্মনবাড়ীয়া পবিত্র কাবা শরীফের উপর মহাদেবের ছবি বসানোর অজুহাতে রসরাজের বাড়ী সহ সেখানে বেশ কয়েকটি হিন্দু বাড়ী তছনছ করা হয়েছিল, কিন্তু প্রকৃত ধর্ম অবমাননাকারী ধরা পড়ার পর দেখা গেলো সে লোক একজন মুসলিম ধর্মাবলম্বী। প্রকৃত ধর্ম অবমাননাকারী ধরা পড়ার পর ঐ মুসলিম দুস্কৃতিকারী মানুষটার উপর আগ্রাসী ঐ মানুষ গুলোর কোন প্রতিক্রিয়া কিন্তু লক্ষ্য করা যায়নি। (২) ১৫ মার্চ ২০১৭ বাংলাদেশের দাউদকান্দির হিন্দু পাড়া সংলগ্ন এক মাদ্রাসায় রাতের অন্ধকারে প্রায় ১৬টি কোরান হাদিসের উপর মল ত্যাগ করা হয়েছে – এই খবর যখন চাউর করে সন্দেহের তীর পাশের হিন্দু বাড়ী গুলোর দিকে দেয়া হয়েছিলো, পরে যখন হাবিবুর রহমান ও তার দুই মুসলিম বন্ধু পুলিশি অভিযানে ধৃত হয় ও স্বীকারোক্তি দিয়ে এধরনের জঘন্য কাজের দায় নিজে নেয়ার পরও কোন মুসলিম ধার্মিক গোষ্ঠী হাবিবুর রহমান ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে এ্যাকশনতো দূরের কথা বিচারের জন্য কোন দাবীও করে নাই। (৩) পুরান ঢাকায়, মুসলিম ছেলেরা হিন্দু সেজে মুসলিম হিজাবী মেয়ের গায়ে মুখে আবির দেয়, শ্লীলতাহানি করে –এই কর্ম করে ধরা পড়া মুসলিম ও যুবকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্...

‘মেরুদণ্ডহীন’ হিন্দু সম্প্রদায় ও ‘সাম্প্রদায়িক’ বাংলাদেশ - চিররঞ্জন সরকার

তিনি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। ফোনে যখন আলাপ হচ্ছিল, তখন ঝাঁজালো কণ্ঠে বললেন, “কী-যে সব প্যানপ্যানানি লেখা লেখেন। এসব বাদ দ্যান। পারলে শক্ত করে লেখেন। না হলে লেখালেখি বাদ দেন। আর লিখেই-বা কী লাভ? রাস্তায় নামতে পারেন না? অস্তিত্ব হুমকির মুখে, আর আপনারা চুপচাপ বসে আছেন। আপনাদের পরিণতিও একসময় রোহিঙ্গাদের মতো হবে।” উনি এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেলেন। আমি শুনলাম। এই কথাগুলো যে আমি বুঝি না বা দেশের হিন্দুরা বোঝে না, তা তো নয়। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে কী-ই-বা বলার বা করার আছে? এদেশে হিন্দুদের যা পরিস্থিতি– যেভাবে অপমান-নির্যাতন-হামলা চালানো হচ্ছে– রাষ্ট্র, সরকার, প্রশাসন, রাজনৈতিক দল, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ যে আচরণ করছে– তাতে হিন্দুদের মার খাওয়া ছাড়া, মেনে নেওয়া ছাড়া, বিলাপ ও চোখের জল ফেলা ছাড়া, দগ্ধ হওয়া ছাড়া, ‘গোপনে দেশত্যাগ’ ছাড়া আর কী-ই-বা করার আছে? হ্যাঁ, হিন্দুরা যা করতে পারে, যা করতে পারত, যা করা উচিত ছিল তা হল, ‘প্রতিরোধ’ গড়ে তোলা। কিন্তু এদেশে বসবাসকারী হিন্দুরা, আমাদের পূর্বপ্রজন্মের নেতারা (হিন্দু-নেতারা, ‘হিন্দু-নেতা’ শব্দটি ব্যবহার করতে বিবেকে বাধছে, কিন্তু উপায় কী) সঠিক সময়ে সঠ...

১৯ আগষ্ট ২০২২ জন্মাষ্টমী উপলক্ষ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা'র বক্তব্য

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১৯ আগষ্ট জন্মাষ্টমী উপলক্ষ্যে বক্তব্য দিয়েছেন। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা অনেক আশা নিয়ে ছিলাম তিনি সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় এবং সংখ্যালঘু কমিশন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ঘোষণা দেবেন। এটি ছিলো আওয়ামীলীগের নির্বাচনী ওয়াদা। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সাথে আমরা দেখলাম তিনি এব্যাপারে কোনো ঘোষণা দিলেন না। বক্তব্যের শুরুতে তিনি ১৫ আগষ্টের কালো রাতে যারা মৃত্যুবরণ করেন তাদের কথা স্মরণ করেন। ১৫ই আগষ্ট কালো রাতে খুনীরা শুধু বঙ্গবন্ধুকে খুন করে নাই, পুরো পরিবারকে নৃশংসভাবে খুন করেছিলো পাকি প্রেত্মারা। শুধু তাই নয় যেসব ব্যক্তি এবং পরিবার এই নৃশংস ঘটনার বিপরীতে গর্জে উঠতে পারে তাদেরকেও স্বপরিবারে খুন করেছিল। এরপর আমরা দেখেছি ৪ নেতাকে খুন করেছিলো শয়তানরা। আমি বিশেষভাবে কর্ণেল জামিলকে স্মরণ করতে চাই- যিনি একমাত্র ব্যক্তি কারো অপেক্ষায় না থেকে একাকী ছুটে গিয়েছিলেন ধানমন্ডিতে। এবং তিনিও সেই নৃশংস ভাগ্য বরণ করেছিলেন। এই ঘটনাগুলো আমরা জানি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এত বছর পরেও সে ঘটনা স্মরণ করে বার বার কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। এহেন ঘটনায় তিনি যদি ব্যথিত হন, তিনিই তো সর্বোচ্চ বোঝার কথা হিন্দুদের বাড়ি...