সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

‘মেরুদণ্ডহীন’ হিন্দু সম্প্রদায় ও ‘সাম্প্রদায়িক’ বাংলাদেশ - চিররঞ্জন সরকার

তিনি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। ফোনে যখন আলাপ হচ্ছিল, তখন ঝাঁজালো কণ্ঠে বললেন, “কী-যে সব প্যানপ্যানানি লেখা লেখেন। এসব বাদ দ্যান। পারলে শক্ত করে লেখেন। না হলে লেখালেখি বাদ দেন। আর লিখেই-বা কী লাভ? রাস্তায় নামতে পারেন না? অস্তিত্ব হুমকির মুখে, আর আপনারা চুপচাপ বসে আছেন। আপনাদের পরিণতিও একসময় রোহিঙ্গাদের মতো হবে।”

উনি এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেলেন। আমি শুনলাম। এই কথাগুলো যে আমি বুঝি না বা দেশের হিন্দুরা বোঝে না, তা তো নয়। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে কী-ই-বা বলার বা করার আছে? এদেশে হিন্দুদের যা পরিস্থিতি– যেভাবে অপমান-নির্যাতন-হামলা চালানো হচ্ছে– রাষ্ট্র, সরকার, প্রশাসন, রাজনৈতিক দল, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ যে আচরণ করছে– তাতে হিন্দুদের মার খাওয়া ছাড়া, মেনে নেওয়া ছাড়া, বিলাপ ও চোখের জল ফেলা ছাড়া, দগ্ধ হওয়া ছাড়া, ‘গোপনে দেশত্যাগ’ ছাড়া আর কী-ই-বা করার আছে?

হ্যাঁ, হিন্দুরা যা করতে পারে, যা করতে পারত, যা করা উচিত ছিল তা হল, ‘প্রতিরোধ’ গড়ে তোলা। কিন্তু এদেশে বসবাসকারী হিন্দুরা, আমাদের পূর্বপ্রজন্মের নেতারা (হিন্দু-নেতারা, ‘হিন্দু-নেতা’ শব্দটি ব্যবহার করতে বিবেকে বাধছে, কিন্তু উপায় কী) সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। তারা একটু করে পরাজয় স্বীকার করেছেন। লেজ গুটিয়ে পিছু হটেছেন। রুখে দাঁড়ানোর ব্যাপারে যারা নেতৃত্ব দিতে পারতেন, তারা মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে শেখেননি। তাই অন্যকেও শেখাতে পারেননি। তাদের অনেকে দেশ থেকে ভেগেছেন। আবার অনেকে বড় দলগুলোর ‘লেজনাড়া’ প্রাণিবিশেষ হয়ে, তাদের দেওয়া একটু ‘খুদকুড়ো’ পেয়েই সন্তুষ্ট থেকেছেন। কেউ কেউ হিন্দুদের স্বার্থরক্ষার নামে ‘সাইনবোর্ড-সর্বস্ব দোকান’ একটা খুলেছেন বটে, কিন্তু পূজা-আয়োজন আর জন্মাষ্টমিতে রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ‘দেখা’ করা ছাড়া তাদের আর কোনো ভূমিকা নেই।

পরিণতিতে বাঘা যতীন, সূর্যসেন, প্রীতিলতার উত্তরসূরীরা এখন শ্যামল কান্তি-রসরাজ-টিটু রায়ে পরিণত হয়েছেন।

অবশ্য শুধু নেতাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই, আমরা এদেশে বসবাসকারী হিন্দুরা সবাই আসলে মেরুদণ্ডহীন। ‘মেরে মরা’, দশটা খেলে অন্তত একটা পাল্টা থাপ্পড় দেওয়ার চিন্তা আমাদের মাথায় কোনোদিনই আসেনি। মার খেয়েছি। অপমান সয়েছি। তারপর একদিন ‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপী গরিয়সী’ বলে চোখের জল ফেলতে ফেলতে সীমান্ত পাড়ি দিয়েছি। যাদের সুযোগ বা প্রবল ইচ্ছেশক্তির জোর আছে, তারা দেশত্যাগ করেছে। আর যাদের সেটুকুও নেই, তারা বেশিরভাগই কোনোমতে টিকে আছে– নারায়ণগঞ্জের শ্যামল কান্তির মতো, কান ধরে– অথবা টিটু রায়ের মতো রাষ্ট্রীয় পুলিশের রিমান্ডে।

না, কারও প্রতি কোনো আস্থা নেই। শ্রদ্ধা নেই। না সংখ্যালঘু না সংখ্যাগুরু। এমনকি নিজের প্রতিও কোনো শ্রদ্ধা নেই। আমিই কি পেরেছি প্রয়োজনীয় সময়ে সঠিকভাবে ‘রিঅ্যাক্ট’ করতে? মুখ বুজে থেকেছি। সব মেনে নিয়েছি। কোনো একজন শামীম ওসমান কিংবা এমন ‘হোমড়া-চোমড়া’ কেউ যদি কান ধরে ওঠবস করতে বলে, আমিও নিশ্চয়ই করব। ‘মান-অপমান’ নয়, ‘বাচাঁ’টাই যে আমাদের কাছে মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা যে বাঁচতে ভালোবাসি, জীবন ভালোবাসি!

হিন্দুরা এদেশে আক্রান্ত, উৎপীড়িত। কিন্তু তাদের মধ্যে প্রতিবাদের চেতনা নেই। ঐক্য নেই, ঐক্যবোধও নেই। একটা প্রতিবাদ সমাবেশ তো দূরের কথা সামান্য একটা মানববন্ধন করতে চাইলেও একজন হিন্দুকে খুঁজে পাওয়া যায় না। গুগলে খুঁজলে যেখানে পাকিস্তানি হিন্দুদের প্রতিবাদের ছবি পাওয়া যায় সেখানে বাংলাদেশি হিন্দুদের কেবল বাড়ির উঠানে কান্নাকাটির ছবি মেলে। বেশিরভাগ হিন্দু অন্য হিন্দুর উপর হামলা-নির্যাতনের সময় নীরবতার নীতি গ্রহণ করে। কেউ যদি হিন্দুদের উপর হামলা প্রতিবাদ করে, তবে তাকে ‘সাম্প্রদায়িকতা’ ভাবে।

হিন্দুদের উপর হামলাটা এদের কাছে ‘অসাম্প্রদায়িকতা’ (তাই তখন চুপ থাকে), আর নির্যাতিত হিন্দুর গলা টিপে ধরা যাতে হিন্দুরা বিচার চাইতে না পারে–, এটাও ওদের কাছে ‘অসাম্প্রদায়িকতা’। তখন কোনো হিন্দু যেন প্রতিবাদ করতে না পারে সে ব্যবস্থা করতে মাঠে নামে। এমনই ‘আত্মঘাতী’ এরা! এমন ‘উদার’ ‘মহৎ’ জনগোষ্ঠী মার খাবে না তো খাবে কে?

আসলে আমাদের কী করা উচিত ছিল, কী করা দরকার– এ ব্যাপারে কেউ কি কিছু বলবেন? আমি, আমরা আজ বিভ্রান্ত, বড় বেশি কনফিউসড! এদেশের হিন্দুদেরও কি এলটিটিই (লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলম)- জিএনএলএফ (গোর্খা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট)- হামাস(ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন, ফিলিস্তিন) এর মতো সংগঠন গড়ে তোলা উচিত? অথবা ‘আত্মঘাতী’ হওয়া উচিত? কিন্তু এগুলো করেই-বা কি হয়েছে? অস্ত্র তুলে নিলেই কি সফল হওয়া যায়? সফল হওয়া গেছে? সবচেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশে তেমন ‘মেরুদণ্ডসম্পন্ন’ হিন্দু কোথায়?

এই দেশে আদৌ কি আমাদের বসবাসের কোনো সুযোগ আছে? রংপুরের গঙ্গচড়ায় একটা ফেইক আইডি খুলে টিটু রায়ের নামে ‘ধর্মীয় অবমাননাকর’ পোস্ট দেওয়া হয়েছে। টানা কয়েকদিন ধরে আক্রমণের উস্কানি দিয়ে প্রকাশ্যে প্রচার সমাবেশ করা হয়েছে। এরপর এই সাজানো অপরাধে টিটু রায়ের এবং তার প্রতিবেশি হিন্দুদের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে হাজার হাজার ‘নামহীন-গোত্রহীন’ জনতা। সেই টিটু রায় পুলিশের হাতে আটক হয়েছে, আদালত রিমান্ডের অনুমতি দিয়েছে। একজন আইনজীবীও তার জামিন চায়নি। এই হল সংক্ষেপে আমাদের সাধের ‘গণতান্ত্রিক,’ ‘অসাম্প্রদায়িক’, ‘সভ্য’ রাষ্ট্রের একটি ছোট্ট নমুনা।

আমাদের বিভিন্ন খেতাবে অভিষিক্ত জাতীয় নেতানেত্রীরা ভিন দেশে আক্রান্ত-অত্যাচারিত বিতাড়িত মানুষজনের দুঃখে দুঃখী হন, তাদের জড়িয়ে ধরে কাঁদেন, আর দেশের মধ্যে অন্যায়ভাবে হিংসা ও হিংস্রতার শিকার মানুষকে ‘রিমান্ড’ এবং ‘আইন’ দেখান। রসরাজ-শ্যামল কান্তি-টিটু রায়রা সহানুভূতি ও সমর্থন পান না। সাঁওতাল পল্লী জ্বলে পুলিশের দেওয়া আগুনে। চাকমা পল্লী, হিন্দু পল্লী পুড়ে ছাড়খাড় হয় ‘নামহীন-গোত্রহীন’ ‘ষড়যন্ত্রী’ জনতার আগুনে।

এ ব্যাপারে বলা হয়, তাদের তো ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। অনেকেই ‘টাকা’র অংকে মাপেন সংখ্যালঘুদের ‘ক্ষতি’। এই হল আমাদের দেশে বর্তমানে প্রচলিত হিউম্যানিটির চেহারা।

ধর্মীয় এবং জাতিগত সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন-নিপীড়ন আমাদের দেশে একটি সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। কারণে-অকারণেই তাদের উপর হামলা, আক্রমণ হয়। তাদের জীবন অনিরাপদ করে তোলা হয়। তাদের সম্পদ লুটপাট করা হয়। জায়গাজমি জবরদখল হয়ে যায়। আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠার মধ্যে বেঁচে থাকতে হয়। এটা মানুষের জীবন নয়। অনেকে কথায় কথায় ভারতের উদাহরণ টেনে আনেন। ভারতে মুসলিমদের উপর অত্যাচার হয়, সেটা বাংলাদেশি হিন্দুদের অপরাধ? এই অপরাধে কি ‘হিন্দুশূন্য বাংলাদেশ’ গড়ে তোলা হবে?

এখন মনে হয়, জন্মই যেন আমার, আমাদের আজন্মের পাপ। প্রশ্ন হল, এর থেকে নিষ্কৃতির উপায় কী? সমাধানের পথ কী? হিন্দুদের আপাতত একটাই করণীয় হতে পারে; তা হল, প্রশাসন, রাষ্ট্র, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতানেত্রী, পাড়াপ্রতিবেশিসহ সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর কাছে নিরাপত্তা চাওয়া। সবার কাছে সহিষ্ণুতা প্রার্থনা করা। প্রয়োজনে এ জন্য সংশ্লিষ্টদের হাতে-পায়ে ধরা। শতকরার হিসেবে যারা প্রায় নব্বই ভাগ, তাদের ঔদার্য, সহানুভূতি আর শুভবুদ্ধি জাগিয়ে তোলা ছাড়া হিন্দুদের বাঁচবার আর কোনো উপায় আছে কি?

কিন্তু এটাও কী সম্ভব? এদেশের প্রশাসন, রাষ্ট্র, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতানেত্রী, পাড়াপ্রতিবেশিসহ সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠী কি আদৌ অসাম্প্রদায়িক? নিকট অতীতে আমরা কি কখনও সাম্প্রদায়িকতামুক্ত ছিলাম?

এই দেশে আমরা যুগ যুগ ধরেই বিশুদ্ধ অক্সিজেনের সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প গ্রহণ করেই বেঁচে আছি। মুখে আমরা সবাই ‘মুক্তমনা’ ‘আসাম্প্রদায়িক’ হিসেবে নিজেকে জাহির করি বটে, কিন্তু আসলেই কি আমরা তাই? ‘ধর্ম হল বীজ এবং দারিদ্র্য-অশিক্ষা-কুশিক্ষা বীজ বোনার উপযোগী পরিবেশ। এই বীজ আর অনুকুল পরিবেশ সহজেই আমাদেরকে একেকটা সাম্প্রদায়িক হিউম্যান বোমা হিসেবে তৈরি করেছে। কেউ সামান্য স্ফুলিঙ্গ তৈরি করে দিতে পারলেই হল– বুম করে ফেটে যাই।

সাম্প্রদায়িকতার বিষ যদি রক্তে না থাকত তাহলে মুহূর্তের মধ্যে ধর্মের নামে এমন ‘অধর্ম’ করা সম্ভব হত না। যখন ইন্টারনেট ছিল না, তখনও আমরা গুজবে মত্ত হয়ে হাজার মাইল দূরে সংঘটিত কোনো ঘটনার খবর কানে আসামাত্র ধর্মযুদ্ধের নামে ধ্বংসের নেশায় মত্ত হতে সামান্য বিলম্ব করিনি। এখনও করছি না।

মূল কথা হচ্ছে, হিন্দুরা এ দেশে মোটেও নিরাপদ নয়। তার কারণ ‘রাজনীতি’। দখলের রাজনীতি, অসহিষ্ণুতার রাজনীতি। কমিউনাল মাইন্ডসেটের রাজনীতি। শুধু জামায়াত, বিএনপি বা জাতীয় পার্টি কিংবা শুধু আওয়ামী লীগকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, হিন্দু নিধন-বিতাড়ন-সম্পত্তি দখলের ব্যাপারে কমবেশি সব রসুনেরই ‘কোয়া’ এক। এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ, যারা সব সময় ধোয়া তুলসী পাতা সেজে বসে থাকেন, তাদের মনমানসিকতার খবর কী? যখন হিন্দুবাড়িতে, গাড়িতে, নারীতে হামলা হয় তখন তো দেখি অধিকাংশই তথাকথিত ‘মুসলিম’ সেজে যান। সংখ্যালঘুর সম্পত্তি লুটেপুটে ভোগ করার ব্যাপারে কারও আগ্রহ পনের আনা দেখিনি, আঠারো আনা ছাড়া।

কাজেই কাকে কী বলব? আবারও বলছি, জন্মই যে আমাদের আজন্মের পাপ।

আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, বাংলাদেশটা আসলে কার। শুধু মুসলমানের? নাকি এদেশে বসবাসকারী মুসলিম-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ধর্মপরিচয়নির্বিশেষে সকল নাগরিকের, সব মানুষের?

সূত্রঃ বিডি নিউজ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আমার আব্দুল ও’রকম নয় (লাভ জিহাদ)

সন্দেহজনক উপায়ে সনাতনী ছেলে বা মেয়েদের প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে ধর্মান্তর করা, পরবর্তীতে বিয়ে করাকে লাভ জিহাদ বলে। আমাদের কাছে যেসব তথ্য আছে তাতে আমরা জেনেছি, রীতিমতো বৈদেশিক পয়সা আসে এই জেহাদি কাজের জন্য। সম্প্রতি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রী অংকন বিশ্বাস এর অকাল মৃত্যুতে এই বিষয়টি প্রবলভাবে সামনে এসেছে। একটি মধ্যবিত্ত শিক্ষিত হিন্দু পরিবারে বেড়ে ওঠা একটি ছেলে এবং একটি মেয়ের মনোজগতের মধ্যে হাজার মাইলের তফাৎ আছে। একটি ছেলে বোধ হবার পরই সে উপলব্ধি করে সে যতটুকু মানুষ তার অধিক সে হিন্দু। উঠতে বসতে ঘরে বাইরে সর্বত্র তার চারপাশের মানুষ তাকে বুঝিয়ে দেয় সে হিন্দু এবং একজন দ্বিতীয় শ্রেণির মানুষ। ওই একই পরিবারের একটি মেয়ের জীবন হয় ঠিক উল্টো। উঠতে বসতে চারপাশের মানুষ তাকে বুঝিয়ে দেয় সে হিন্দু এবং একারণেই সে অধিক আদরণীয়। বাবা মা মেয়ের প্রতি বিশেষ নজর দেয়। এই বিশেষ নজর রাখা ২ রকমের হয়। অধিক শাসনে রাখা, বাবা-মা এর সাথে মানসিক দুরত্ব সৃষ্টি হয়। আরেক রকম হচ্ছে মেয়ে যা বলে তাতেই সায় দেয়া। মেয়ে উচ্ছন্নে গেলেও আধুনিক হিন্দু বাবা-মা তাতে তাল দেন। অন্যদিকে বাইরের দুনিয়ায় সে একেবারে রাজেন্দ্রাণির মত...

যুক্তিফাঁদে ফড়িং - চমক হাসান

ডিসক্লেইমারঃ চমক হাসানের লেখা অসাধারণ একটা বই এটি। খুব সহজভাবে যুক্তি, ভ্রান্তি নিয়ে লেখা যা প্রতিটি হিন্দু তথা সকল মুক্তবুদ্ধির মানুষের জন্য অবশ্যপাঠ্য। এখানে এই বইটি উম্মুক্ত করা হয়েছে শুধুমাত্র বাংলাদেশের পরিস্থিতি বিবেচনা করে।  চারিদিকে সাম্প্রদায়িক শক্তির হুংকার দেখা যাচ্ছে। তারা তাদের বিষাক্ত নখ, দাঁত দিয়ে বাংলাদেশকে প্রতিনিয়ত ক্ষত বিক্ষত করছে। এই সাম্প্রদায়িক শক্তি যেসব অস্ত্র দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে তার একটি বড় অস্ত্র হলো এই ভ্রান্তি'র ব্যবহার। ইংরেজিতে যাকে ফ্যালাসি বলে। এটা পড়লে মোটা দাগে কোনটা সুযুক্তি আর কোনটা কুযুক্তি সেটা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পাবেন।  [চমক হাসান ভাই যদি কোনোদিন এই সাইট দেখেন, আপনার ঔদার্যের গুণে ক্ষমা করবেন।] গল্প শুরুর আগে ভ্রান্তি চারিদিকে আন্তনগর মধুমতী এক্সপ্রেস ট্রেনের ভেতরে বসে আছে হাসিব, গন্তব্য 'খোকসা'। ঢাকা থেকে বাসে করে আসা যেত, তাতে সময় অনেক কম লাগত। তবু সে ট্রেনেই আসবে ঠিক করেছিল। ট্রেনে চড়লে নাকি একটা আয়েশি ভাব আসে ওর, ট্রেনের ছন্দ আর দুলুনিতে মনটা খুশি খুশি লাগে। তা ছাড়া স্টেশনে স্টেশনে মানুষের ওঠানামা দেখতে ভালো লাগে। আর...

মুক্তিযুদ্ধে হিন্দুদের আত্মত্যাগ

কয়েকজন বোধহীন বুদ্ধিমান রাজনৈতিক নেতাদের অবিমৃষ্যতার কারণে ১৯৪৭ সালে ভারত ভেঙ্গে পাকিস্তান হলো। দেশ ভাগ হবার আগ-পর যেসব হিন্দু ব্যক্তিবর্গ পাকিস্তান অংশে ছিলেন তাদের বড় একটা অংশ সহায় সম্পত্তি ফেলে পশ্চিম বাংলায় চলে গেলেন। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের মতো কিছু ব্যক্তি পূর্বপুরুষের ভুমি আঁকড়ে ধরে মাতৃভূমির মানুষদের সাথে নিয়ে বাঁচতে চাইলেন। আবার অন্যদিকে যোগেন মণ্ডলের মতো নেতারা উচ্চবর্ণের হিন্দুর থেকে মুসলিমরা শ্রেয় এই মূঢ় তত্ত্বে বিশ্বাস করে জিন্নাহ’র সাথে গাট বাঁধলেন। আদতে ভারতবর্ষের হিন্দুরা কখনো একতাবদ্ধ ছিলো না- যার কারণে ইরান, তুরান, মোগল, মঙ্গোল, সাত সাগরের পার থেকে বিভিন্ন হানাদাররা এসেছে আর এদেশ শাসন করেছে। ইংরেজরা যখন এদেশ ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে তখনো সনাতনীদের কোনো একক দল গড়ে ওঠেনি, নিজেদের মধ্যে কোনো ঐক্য নেই। সেসময় মুসলিমরা মোটা দাগে সবাই মুসলিমলীগের সাথে থাকলেও হিন্দুদের তেমন কোনো গ্রহনযোগ্য দল ছিলো না। হিন্দুদের কেও বাম, কেও কংগ্রেস ইত্যাদি রাজনৈতিক দলে বিভক্ত ছিলো। ১১ আগষ্ট ১৯৪৭ তারিখে পাকিস্তান এসেম্বলিতে জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া প্রথম ভাষণে জিন্নাহ বললেন, “Now I think we should keep ...

দিব্যজ্ঞান নয় কাণ্ডজ্ঞান চাই, শিবপ্রসাদ রায়

দিব্যজ্ঞান নয় কাণ্ডজ্ঞান চাই, শিবপ্রসাদ রায় ছোটোবেলায় একটা বই পড়েছিলাম, নাম “বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা চলে না।” বড় হয়েও এদেশের বহু ঘটনার বুদ্ধি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারছি না। মনে হচ্ছে গোটা দেশের ভাবনা-চিন্তাগুলো যেন একটা অবাস্তব ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে। অবিলম্বে যদি আমরা বাস্তবের মাটিতে পা না রাখতে পারি, আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে চরম সর্বনাশ। এদেশের অর্থনৈতিক বিপর্যয় এবং মনুষ্যত্বের অবক্ষয়ের জন্য দায়ী করা হয় ভারত বিভাগকে। এই ভারত বিভাগ ছিল এদেশের তাবৎ হিন্দু নেতৃবৃন্দের নির্বুদ্ধিতার পরিণতি। শতকরা সাতানব্বই জন মুসলমানের দাবী ছিল : হিন্দু মুসলমান দুটো পৃথক জাতি। হিন্দুর সঙ্গে পাশাপাশি বাস করে মুসলমানদের ধর্ম সংস্কৃতি অক্ষুণ্ণ রাখা অসম্ভব। অতএব আমাদের একটা হোমল্যান্ড চাই, যার নাম পাকিস্তান। মুসলমান সমাজের পুরোটাই যখন ভারতবর্ষকে দুখণ্ড করতে ব্যস্ত, তখন হিন্দু নেতারা কি করছিলেন? জনগণকে বোঝাচ্ছিলেন, হিন্দু মুসলমান পৃথক জাতি নয়। এক জাতি, ভারতীয় জাতি। মুসলীম লীগ এবং মহম্মদ আলি জিন্নার দ্বিজাতিতত্ত্ব এবং পাকিস্তানের দাবী সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। মহাত্মা গান্ধী বললেন : ভারত দ্বিখণ্ডিত হলে তা আমা...

বর্তমান হিন্দু-মুসলমান সমস্যা - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

১৯২৬ সালে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় একটি ভাষন দেন যার নাম “বর্তমান হিন্দু মুসলমান সমস্যা”। এটি বাঙলা প্রাদেশিক সম্মেলনে প্রদান করেন। পরে তা হিন্দু সংঘ পত্রিকায় ছাপা হয় ১৯ শে আশ্বিন ১৯৩৩ সালে। পাঠকদের বলবো মনোযোগ দিয়ে পড়ুন এবং ভাবুন।  ------- কোন একটা কথা বহু লোকে মিলিয়া বহু আস্ফালন করিয়া বলিতে থাকিলেই কেবল বলার জোরেই তাহা সত্য হইয়া উঠে না। অথচ এই সম্মিলিত প্রবল কণ্ঠস্বরের একটা শক্তি আছে এবং মোহও কম নাই। চারিদিক গমগম করিতে থাকে—এবং এই বাষ্পাচ্ছন্ন আকাশের নীচে দুই কানের মধ্যে নিরন্তর যাহা প্রবেশ করে, মানুষ অভিভূতের মত তাহাকেই সত্য বলিয়া বিশ্বাস করিয়া বসে। Propaganda বস্তুতঃ এই-ই। বিগত মহাযুদ্ধের দিনে পরস্পরের গলা কাটিয়া বেড়ানই যে মানুষের একমাত্র ধর্ম ও কর্তব্য, এই অসত্যকে সত্য বলিয়া যে দুই পক্ষের লোকেই মানিয়া লইয়াছিল, সে ত কেবল অনেক কলম এবং অনেক গলার সমবেত চীৎকারের ফলেই। যে দুই-একজন প্রতিবাদ করিতে গিয়াছিল, আসল কথা বলিবার চেষ্টা করিয়াছিল, তাহাদের লাঞ্ছনা ও নির্যাতনের অবধি ছিল না। কিন্তু আজ আর সেদিন নাই। আজ অপরিসীম বেদনা ও দুঃখ ভোগের ভিতর দিয়া মানুষের চৈতন্য হইয়াছে যে, সত্য বস্তু সেদিন...

রক্তাক্ত শারদ’ ২০২১

রক্তাক্ত শারদ’ ২০২১ (১) ২০১৬ সালে ব্রাহ্মনবাড়ীয়া পবিত্র কাবা শরীফের উপর মহাদেবের ছবি বসানোর অজুহাতে রসরাজের বাড়ী সহ সেখানে বেশ কয়েকটি হিন্দু বাড়ী তছনছ করা হয়েছিল, কিন্তু প্রকৃত ধর্ম অবমাননাকারী ধরা পড়ার পর দেখা গেলো সে লোক একজন মুসলিম ধর্মাবলম্বী। প্রকৃত ধর্ম অবমাননাকারী ধরা পড়ার পর ঐ মুসলিম দুস্কৃতিকারী মানুষটার উপর আগ্রাসী ঐ মানুষ গুলোর কোন প্রতিক্রিয়া কিন্তু লক্ষ্য করা যায়নি। (২) ১৫ মার্চ ২০১৭ বাংলাদেশের দাউদকান্দির হিন্দু পাড়া সংলগ্ন এক মাদ্রাসায় রাতের অন্ধকারে প্রায় ১৬টি কোরান হাদিসের উপর মল ত্যাগ করা হয়েছে – এই খবর যখন চাউর করে সন্দেহের তীর পাশের হিন্দু বাড়ী গুলোর দিকে দেয়া হয়েছিলো, পরে যখন হাবিবুর রহমান ও তার দুই মুসলিম বন্ধু পুলিশি অভিযানে ধৃত হয় ও স্বীকারোক্তি দিয়ে এধরনের জঘন্য কাজের দায় নিজে নেয়ার পরও কোন মুসলিম ধার্মিক গোষ্ঠী হাবিবুর রহমান ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে এ্যাকশনতো দূরের কথা বিচারের জন্য কোন দাবীও করে নাই। (৩) পুরান ঢাকায়, মুসলিম ছেলেরা হিন্দু সেজে মুসলিম হিজাবী মেয়ের গায়ে মুখে আবির দেয়, শ্লীলতাহানি করে –এই কর্ম করে ধরা পড়া মুসলিম ও যুবকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্...

১৯ আগষ্ট ২০২২ জন্মাষ্টমী উপলক্ষ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা'র বক্তব্য

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১৯ আগষ্ট জন্মাষ্টমী উপলক্ষ্যে বক্তব্য দিয়েছেন। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা অনেক আশা নিয়ে ছিলাম তিনি সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় এবং সংখ্যালঘু কমিশন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ঘোষণা দেবেন। এটি ছিলো আওয়ামীলীগের নির্বাচনী ওয়াদা। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সাথে আমরা দেখলাম তিনি এব্যাপারে কোনো ঘোষণা দিলেন না। বক্তব্যের শুরুতে তিনি ১৫ আগষ্টের কালো রাতে যারা মৃত্যুবরণ করেন তাদের কথা স্মরণ করেন। ১৫ই আগষ্ট কালো রাতে খুনীরা শুধু বঙ্গবন্ধুকে খুন করে নাই, পুরো পরিবারকে নৃশংসভাবে খুন করেছিলো পাকি প্রেত্মারা। শুধু তাই নয় যেসব ব্যক্তি এবং পরিবার এই নৃশংস ঘটনার বিপরীতে গর্জে উঠতে পারে তাদেরকেও স্বপরিবারে খুন করেছিল। এরপর আমরা দেখেছি ৪ নেতাকে খুন করেছিলো শয়তানরা। আমি বিশেষভাবে কর্ণেল জামিলকে স্মরণ করতে চাই- যিনি একমাত্র ব্যক্তি কারো অপেক্ষায় না থেকে একাকী ছুটে গিয়েছিলেন ধানমন্ডিতে। এবং তিনিও সেই নৃশংস ভাগ্য বরণ করেছিলেন। এই ঘটনাগুলো আমরা জানি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এত বছর পরেও সে ঘটনা স্মরণ করে বার বার কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। এহেন ঘটনায় তিনি যদি ব্যথিত হন, তিনিই তো সর্বোচ্চ বোঝার কথা হিন্দুদের বাড়ি...