পাকিস্তানের তৎকালীন কেন্দ্রীয় যোগাযোগমন্ত্রী আব্দুস সবুর খান ১৯৬০ সালে খুলনা জেলার মাটিখালীর একজন সম্ভ্রান্ত হিন্দু রূপচাঁদ বিশ্বাসের ৩০ বিঘা জমি জোরপূর্বক দখল করে নেয় এবং সেখানে একটি তিনতলা ভবন নির্মাণ করে। রূপচাঁদ বিশ্বাস সাহসের সাথে আব্দুস সবুর খানের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় সবুর খান পরাজিত হয় এবং আদালত তাকে ১,৩৫,০০০ রুপি পরিশোধের নির্দেশ দেয়। কিন্তু সবুর খান বিচারালয়ের বাইরে এই দখলবাজির মীমাংসা করতে চাইলেও রূপচাঁদ তা দৃঢ় ভাবে প্রত্যাখান করেন। এর মাঝেই মজিদ মিয়াঁ নামে সবুর খানের মনোনীত প্রার্থী জেলা পরিষদ নির্বাচনে শোচনীয় ভাবে পরাজিত হয়। সবুর খান ও চামকুরি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সহ তাদের দলের অন্যান্য সদস্যরা এই পরাজয়ের কারণ হিসেবে হিন্দুদেরকে দায়ী করে এবং হিন্দুদের প্রতি হুমকি,ভয়-ভীতি প্রদর্শন করতে শুরু করে। এই নাজুক অবস্থার মধ্যেই হজরতবাল ঘটনার গুজব ছড়ানো হয়। সবুর খান খুলনায় হিন্দু নিকেশের জন্য এই সুযোগটি দ্রুত লুফে নেয়।
১৯৬৪ সালের ২ জানুয়ারি তারিখে হজরতবাল ঘটনার প্রেক্ষিতে মুসলিমরা হিন্দুদেরকে পায়ে জুতো পরতে, মাথায় ছাতা ব্যবহার করতে কিংবা রিকশায় চড়তে বাধা দেয়। মধ্যাহ্নে মুসলিমরা সমগ্র খুলনাব্যাপী মিছিল বের করে এবং মিছিল থেকে হুঙ্কার আসতে থাকে, ‘হিন্দুদেরকে হত্যা কর’। বিকাল চারটার দিকে খুলনায় হিন্দু নিধন শুরু হয়। টানা চার ঘণ্টা এই বীভৎস ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির পর রাত আটটায় সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। এই তীব্র উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মাঝেই পাকিস্তান প্রাদেশিক মুসলিমলীগ ৩ জানুয়ারিকে কাশ্মীর দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। খুলনায় সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান করে পরিস্থিতিকে আরও বিভীষিকাময় ও সন্ত্রস্ত করে তোলার প্রয়াস চালানো হয়। খুলনার এক প্রান্তে দৌলতপুর শিল্প এলাকায় এক বিশাল জনসভায় আব্দুস সবুর খান বক্তব্য প্রদান করে। হাজার হাজার উগ্র মুসলিম বিশেষ করে বিহারীরা ভয়ঙ্কর সব মারণাস্ত্র হাতে নিয়ে এই উস্কানিমূলক বক্তব্য শ্রবণ করে। সবুর খান এই সুযোগে হিন্দু বিদ্বেষী এবং ভারত বিরোধী জ্বালাময়ী ভাষণ প্রদান করে। তৎক্ষণাৎ সেই সমাবেশ থেকে প্রায় ২০,০০০ মুসলিম জনতা সেনহাটি (দিঘলিয়া উপজেলা), মহেশ্বরপাশা, পাবলা,চন্দনীমহল, দৌলতপুরসহ আশেপাশের হিন্দুপ্রধান জনবসতি গুলোর উপর তীব্র আক্রোশে আক্রমণ শুরু করে। সেখানকার হিন্দুদের বাড়ি-ঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মস্থান লুট ও অগ্নিসংযোগ শুরু করে তারা। অনেক হিন্দুকে নির্মম ভাবে হত্যা করে মুসলিমরা। এদের মধ্যে একটি দল সড়ক ও রেলপথ ধ্বংস করতে করতে সন্ধ্যায় খুলনা শহরে উপস্থিত হয়। পরবর্তী চার দিন খুলনার হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর লাগামহীন হত্যা,ধর্ষণ,অপহরণ, লুণ্ঠন, ধ্বংসের এক বন্য বীভৎসতা চলে। খুলনা শিপইয়ার্ড, দাদা কোম্পানি,ইস্পাহানী কোম্পানি,কাটা কোম্পানি, সোলম্যান কোম্পানিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার মুসলিম শ্রমিকরা হিন্দুদের উপর এই জঘন্য, অমানবিক জিঘাংসাবৃত্তি চরিতার্থ করে। লোপপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এদেরকে মারণাস্ত্র সরবরাহ করে এই পাশবিক হিন্দু নিধনকে উৎসাহিত করে। খুলনা লঞ্চঘাটে কমপক্ষে ২০০-৩০০ হিন্দুকে নির্মমভাবে হত্যা করে মুসলিম হত্যাকারীরা। খুলনা থেকে চালনা পর্যন্ত রাস্তার দু’দিকে থাকা প্রতিটি হিন্দু জনপদ,গ্রাম ধ্বংস করে দেয় মুসলিমরা। ৪ জানুয়ারি মোংলায় হিন্দু হত্যাযজ্ঞের বিস্তার লাভ করে। মোংলা বন্দরে ৩০০ হিন্দুকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
বাগেরহাটের রামপালে আব্দুস সবুর খান আরও তিনটি জনসভা করে। সেখানে পূর্ব-পাকিস্তানে চলমান প্রলয়ঙ্কারী হিন্দু নিধনের বিশদ বর্ণনা সংবলিত প্রচারপত্র বিলি করতে শুরু করে মুসলিমরা। বাঙ্গালী হিন্দুদেরকে অবিলম্বে পাকিস্তান ত্যাগের জন্য হুমকি প্রদান করে তারা। লোপপুর বাজারে আব্দুস সবুর খান অন্য একটি জনসভায় সদর্পে ঘোষণা করে, সে হিন্দুদের পৃষ্ঠদেশ থেকে চামড়া তুলে পায়ের জুতো তৈরি করবে। হিন্দুদের উপর মাত্রা ছাড়া গণহত্যার ভিত রচনা করে সবুর খান তার ভ্রাতুষ্পুত্রীর বিয়ের জন্য এক রাজকীয় অনুষ্ঠান আয়োজন করে। ফলে একদিকে দিন দিন গণহত্যার তীব্রতা বাড়তে থাকে অন্যদিকে বিয়ের অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয় পূর্ব-পাকিস্তানের কুখ্যাত গভর্নর আব্দুল মোনায়েম খান, ভূতপূর্ব পূর্ব-পাকিস্তান আইনপরিষদের সদস্য এবং তৎকালীন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য কাজী আব্দুল কাদের। খুলনার বিখ্যাত আইনজীবী অরবিন্দ ভট্টাচার্য এই নৃশংস হিন্দু হত্যাবন্ধের জন্য দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য তাকে অনুরোধ করেন। কিন্তু সবুর খান তার ভ্রাতুষ্পুত্রীর বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজনের ব্যস্ততা দেখিয়ে কোনরূপ ব্যবস্থা অপারগতা প্রকাশ করে।
