লক্ষ্মীপূজার দিন শুক্রবার বেলা ১০টার সময় প্রথমে বহুলােক টেটা, বল্লম, দুটো বন্দুক নিয়ে আসে, তখন আমরা মেয়েরা সকলেই ছাদের উপরে উঠি। তখন দুবৃত্তরা চারিদিকে আগুন লাগাইয়া দেয়। মণীন্দ্রবাবু, কানু রায় (প্যারী রায়ের ছেলে) দুজনে গিয়ে মাপ চাইতে যায় এবং মাপ চাইতে না চাইতেই মণিকে নিয়াই কাটিয়া ফেলে, কানুর বুকে বল্লম মারে। তারপর অনর্গল ইট-বর্ষণ হয় এবং বর্ণনাকারিণীর চোখের উপরেই ইট লাগে। তারপর ছাদের উপর হইতে পুরুষ ও মেয়েরা মাপ চাইতে থাকে। দুর্বত্তরা নীচু হইতে অস্ত্র শস্ত্র ছুড়িয়া মারিতে সকলেই ছাদের উপরে শুইয়া পড়ে। সকলেই অল্পবিস্তর আহত (হন) এবং উঠিয়া মার্জনা প্রার্থনা করে যে আমাদের মারবেন না, যা চান বলুন আমরা দিতেছি। তাহাতে জনতা বলে তােমরা আগে নামিয়া এসাে। তখন মেয়েরা বলেন যে চারিদিকে আগুন জ্বলিতেছে আমরা কেমনে নামিব। তখন নীচু হইতে নারিকেল গাছ কাটিয়া উপরে উঠিয়া বলে মু$লমান হবি কিনা? আমরা অনেকেই স্বীকার করি, এবং দাবি (করি) যেন আমাদের উপরে কোন অত্যাচার করা না হয়। তখন তাহারা বলে যে নির্ভয়ে নাম। তখন তাহারা আমাদিগকেই হাত ধরিয়া নামিতে সাহায্য করে। এবং নামাইবার সময় গা হইতে অলংকারগুলি টানিয়া খুলিয়া লওয়া হয়।
এর আগে পুরুষদিগকে পিটাইতে থাকে। এবং রাজেনবাবুকে খোঁজ করিতে থাকে। রাজেন বাবুকে কলার পাতায় ঢাকিয়া রাখা হইয়াছিল। তারপর খোঁজ করিয়া ধরিয়া ফেলে। রাজেনবাবুর স্ত্রী বলেন যে আগে আমাকে হত্যা না করিয়া উহাকে মারিতে পারিবেন না কয়েকজন মিলিয়া রাজেনবাবুর স্ত্রীকে ধরিয়া রাখে এবং রাজেনবাবুকে হাত বাঁধিয়া নীচে নামান হয় এবং তিনি নামিবামাত্রই একজন টেটা ছুড়িয়া তার প্রতি নিক্ষেপ করে, তাহা আসিয়া রাজেনবাবুর পাছায় লাগে। তখন তিনি বলেন যে আমার মাথা ঘুরিতেছে, দাঁড়াইতে পারিতেছি না। তারপর রাজেনবাবুকে ধরিয়া আম গাছের তলায় গোলাম সরোয়ার বিশ হাত তফাতে দাঁড় করান হয় এবং বিশ (হাত) তফাত থেকে গোলাম সরোয়ার তাহাকে গুলি করিয়া মারে, গুলি রাজেনবাবুর বুকে লাগে। তাহাকে একটু দূরে লইয়া গিয়া মাথা কাটা হয়। তারপর গোলাম সরোয়ার হুইসিল দেয় এবং সকলে থামে। যখন এই কাণ্ড চলিতেছিল তখন অন্যান্য পুরুষদিগকে ছাদ হইতে এক এক করিয়া নামাইয়া হত্যা করা হইতেছিল। নগেন রায়ের আট বছরের ছেলেকে ছাদের উপর থেকে আগুনে ফেলিয়া দেওয়া হইয়াছিল, কিন্তু তাহার মৃত্যু হয় নাই, বাঁচিয়া গেছে। তারপরেই গােলাম সরােয়ার যখন চলিয়া যাইতে থাকে তার পিছনে বাড়ীর সমস্ত মেয়েদের লইয়া চলিতে থাকে। যাইবার সময় আমি দুই পাশে তাকাইয়া দেখিতে পাই ভাতের ডেকচিতে নগেন রায়কে কাটিয়া রাখা হয় এবং ডালের ডেকচিতে সতীশবাবুর আধকাটা শরীর রহিয়াছে। গােলাম সায়েরের বাড়ীতে যখন পৌছান হইল তখন রাত্রি হইয়া গিয়াছিল। আমাদের দেখিয়া যাহারা আমাদের লইয়া গিয়াছিল তাহাদের ধমক দিয়া বলে যে কেন ইহাদের এখানে আনিয়াছ? ইহাদের বাড়ীতে ফিরাইয়া দাও। কিন্তু বাড়ী তখন পুড়িতেছিল। আমাদের তখন ভিন্ন ভিন্ন হি.ন্দু ও মু$লমান বাড়ীতে রাখা হয়। সকাল বেলায় আমরা বাড়ীতে ফিরি ও ছােট ঘরে আশ্রয় লই। সকাল ৮টার সময় কয়েকজন বড় বড় বেতের বড় ঝুরি ও দা লইয়া আসে এবং নিহত ব্যক্তিদের মাথা কাটিয়া ঝুড়ি ভরিয়া লইয়া যায়। একমাত্র কানুবাবু ভীষণভাবে আহত হইয়া একটি ঝোপের মধ্যে পড়িয়া ছিলেন। তাহাকেইহারা দেখিতে পায় নাই। রাত্রে তাহার আর্ত্নাদ শুনিয়া মজুমদার বাড়ীর লােকেরা তাহাকে লইয়া যায়। পরের সোমবার লাসগুলি সরাইয়া লইয়া যাওয়া হয়। কানুবাবু সেইদিন মারা যায়, কানুবাবুকে ওরা আসিয়া কবর দেয়। এরপর একদিন ডাফরান সাহেব আসিয়া রাজেনবুর স্ত্রী ও মেয়েদিগকে লইয়া যান; অন্য কাহাকেও লইতে অস্বীকার করেন।
সাতদিন পরে লামচর হইতে প্রথমে পুলিশ দেখা দেয়। এ হত্যাকাণ্ডের মধ্যে ছাদ ধ্বসিয়া মাত্র তিনজনের মৃত্যু হয়, বাকী সকলের অস্ত্রাঘাতে মৃত্যু হয়। ইহার মধ্যে ছিনাইয়া লওয়া কালাচাদের রায়ের স্ত্রী, নমিতা, খুকু
নিহতদের তালিকা
(১)কালীকুমার রায় ও আর দুইজন ছাদ ধ্বসিয়া মৃত্যু হয়। (৪)রাজেনবাবু (৫)চিন্তাহরণবাবু (৬)সতীশবাবু (৭)মণীন্দ্রবাবু (৮)গােপাল (৯)নগেন্দ্রবাবু (১০)জয়চন্দ্র (১১)মনােমােহন (১২)হরেন্দ্র রায় (১৩)ব্রজনাথ দাস (১৪)যশােদ ধুপী (১৫)বারুই বাড়ীর দুটি ছেলে (১৬)প্রসন্ন রায় (১৭)কালু রায় (১৮)অক্ষয় রায় (১৯)সুর্য্য রায় (২০)মােনা (২১)খােকা (২২)নেপু (সূর্যাযরায়ের ছেলে) (২৩)মজুমদার (২৪)কালীপদ রায়।
তথ্যসূত্রঃ~ সাতচল্লিশের ডায়রি :নির্মলকুমার বসু।
_______________________________________________
সাহিত্যিক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন:- ❝ যে জাতির ইতিহাস নাই তাহার ভবিষ্যৎ নাই। ❞
তাই বাঙালিকে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হবে, আর কতদিন বাঙ্গালী ইতিহাস থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকবে তার ওপরেই নির্ভর করছে বাঙ্গালী হিন্দুর ভবিষ্যৎ



