১৯৪৬ সালের ১০ অক্টোবর কোজাগরী পূর্ণিমা লক্ষ্মিপুজার রাতে নোয়াখালীতে ভয়ংকর হিন্দু ম্যাসাকারের কোন নিউজও পূর্ব পাকিস্তানের কোন খবরের কাগজ প্রকাশ করেনি। সর্ব প্রথম নিউজ প্রকাশ করে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালিত দৈনিক স্বাধীনতা পত্রিকা। পূর্ববঙ্গের প্রাদেশিক হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সরকার পুরো ঘটনাকে তুচ্ছ, স্থানীয় বিবাদ হিসেবে আখ্যা দেন যখন কোলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিকগুলিতে নোয়াখালীর নিউজ আসতে থাকে। তখন ঢাকা থেকে প্রকাশিত ইংরেজি দৈনিক মর্নিং নিউজ লেখেন, তুচ্ছ ঘটনাকে ‘হিন্দুদের প্রকাশিত পত্রিকায়’ বড় করে দেখানো হচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত খবরের কাগজের এ সময়ের কিছু শিরোনাম দেখে নেয়া যাক-
‘দৈনিক যুগান্তর’ ‘নোয়াখালীতে পাঁচ সহস্রাধিক নিহত ও অর্ধলক্ষাধিক বিপন্ন’ একই নিউজে একাধিক উপশিরোনাম ছিলো: ‘চাঁদপুর শহরের দিকে উন্মত্ত আক্রমণকারী দল’
‘মহকুমার সর্বত্র ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও গুণ্ডামী’
‘কংগ্রেসী নেতৃবৃন্দের বিমানযোগে উপদ্রুত অঞ্চল পরিদর্শনের ব্যবস্থা’। আরেকটি নিউজ এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয় গুরুত্ব দিয়ে, ‘নোয়াখালীতে হত্যা অবাধ গুণ্ডামী: কেন্দ্রীয় সরকারকে হস্তক্ষেপ করিতে অনুরোধ, শরৎচন্দ্রের নিকট শ্যামাপ্রসাদের তার’।
আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা এপি বরাতে দৈনিক স্বাধীনতার শিরোনাম: ‘নোয়াখালী থেকে ‘হাজার হাজার লোকের পলায়ন’
অমৃতবাজার পত্রিকায় শিরোনাম: ‘Riotious mobs with deadly weapons are raiding villages and looting, murder and arson are continuing…on a very large scale…’
কোনভাবেই সত্য চেপে রাখা যায়নি সেই সোশাল মিডিয়া না থাকা যুগে, যখন একটি দৈনিক খবরের কাগজ দেশের সর্বত্র পৌঁছাতো না। সে যুগেও সত্য চেপে থাকেনি। কারণ জানা যাচ্ছে কোলকাতা থেকে প্রকাশিত খবরের কাগজগুলোতে নিউজ প্রকাশের পরই পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক সরকারও প্রেসনোট দিয়ে ঘটনা যে একটি ঘটেছে সেটি স্বীকার করতে বাধ্য হয়। অপরদিকে জওহরলাল নেহরু লর্ড ওয়াভেলকে চিঠি লিখে নোয়াখালী ঘটনায় তার নিজের ক্ষোভের কথা জানিয়েছিলেন। বলে রাখা ভালো, নেহরু কোলকাতা দাঙ্গার সময় নিজে পিস্তল হাতে দাঙ্গাকারীদের থামিয়ে দিয়ে ভূয়ষী প্রসংশা লাভ করেছিলেন। এমনকি সোহরাওয়ার্দী পর্যন্ত বলতে বাধ্য হয়েছিলেন যে পাটনায় নেহরু যেভাবে দাঙ্গা থামিয়েছিলেন তা ভোলার নয়।
তো যা বুঝতে পারেন, এই সাম্প্রদায়িক হামলার পর সব কিছু ধুয়েমুছে অস্বীকার করার চেষ্টা সর্বত্র দেখি সেটি আসলে এখানকার একটি পরম্পরা! বাবরি মসজিদ ইস্যু নিয়ে সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামার পর এরশাদ সরকার যেমন সব কিছু গোপন করতে চেয়েছে, আশ্চর্য যে এরশাদের বিরোধী হলেও সেসময় একটা জাতীয় ঐক্য চোখে পড়ে হিন্দুদের উপর হামলাকে ঢেকে রাখতে। যেমন আহমদ ছফা বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ছাড়া আর কিছু ঘটেনি বলে তখন মত দিতেন। এবারো দেখলাম চরম আওয়ামী লীগের শত্রুও দূর্গাপুজায় হামলাকে গোপন করছে। সরকার বেকায়দায় পড়বে সেটা তাদের কাছে বড় কথা নয়, বড় কথা হিন্দুদের উপর নির্যাতন হচ্ছে এখন সেটাকে ঢেকেঢুকে রাখতে সবাই এক! ইনকিলাবের মত পত্রিকার শিরোনাম ছিলো "ধুমধাম আনন্দ উৎসাহের মধ্যে দুর্গোৎসব পালিত হয়েছে"!
